রাম কিংবা রামায়ণকে পৌরাণিক তথা কাল্পনিক বলাই অপরাধ। আর তার শাস্তিতেই সম্প্রতি চাকরি খোয়াতে হল এক শিক্ষিকাকে। যদিও এমন ঘটনা এই প্রথমবার ঘটছে না। শিক্ষাক্ষেত্রে নানা মত, নানা কথার চর্চা হয়েই থাকে; কিন্তু তার কণ্ঠরোধ করার এহেন পুনরাবৃত্তি ঘটলে প্রশ্ন জাগে, তবে কি সেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার আদানপ্রদানের সামনেই টানা হচ্ছে লক্ষ্মণরেখা? যে কারণে হীরক রাজার দেশে এসেছিল পাঠশালা বন্ধের নির্দেশ? ভেবে দেখা যাক নাহয়।
হীরক রাজার দেশে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শাসকের সুরের থেকে ভিন্ন সুরে কথা বলা চলবে না। অর্থাৎ, নিজস্ব চিন্তা, মত, আদর্শ সবকিছুকে ঢেলে নিতে হবে একই ছাঁচে, যে ছাঁচ শাসকের গড়ে দেওয়া। এ একরকমভাবে মগজে কারফিউ জারি করারই নির্দেশ। যা না করলে পাঠশালা বন্ধের নির্দেশ আসে, কেননা ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে।’ অথচ পাঠশালা, থুড়ি শিক্ষার আঙিনায় বেশি জানারই তো কথা ছিল। শিক্ষার পরিসরে সবরকমের কথা হবে, ভাবনার বৈচিত্র্য থাকবে সেখানে, নিরপেক্ষভাবে যে কোনও মত খুঁটিয়ে ও খতিয়ে দেখা হবে, এমন খোলা হাওয়াই তো থাকার কথা। কারণ শিক্ষাই তো সেই শানিত আয়ুধ, যা সত্যের সঙ্গে কোনোরকম আপস করে না। কিন্তু বারবার সেই ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করা হলে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে একমাত্রিকতার ছাঁচেই বাঁধতে চাওয়া হচ্ছে শিক্ষাকেও? সম্প্রতি আরও এক ঘটনায় ফের উসকে উঠল সেই আশঙ্কা। পড়াতে গিয়ে শ্রীরামচন্দ্রকে ‘পৌরাণিক চরিত্র’ বলেছেন কেন, এই অভিযোগেই বরখাস্ত করা হল কর্নাটকের এক শিক্ষিকাকে। তাঁর বিরুদ্ধে এমনকি তদন্তও শুরু হয়েছে, ক্ষমা প্রার্থনা করে বিবৃতিও দিয়েছেন কনভেন্ট স্কুলটির কর্তৃপক্ষ।
আরও শুনুন:
মুদ্রায় খোদাই রাম-সীতার ছবি, সমন্বয়ের বার্তা দিয়েছিলেন সম্রাট আকবর
কিন্তু কথা হল, এমন ঘটনা এই প্রথমবার ঘটছে না। এ দেশে ধর্মীয় অনুষঙ্গকে অন্য আলোয় দেখতে চেয়ে অনেকসময়ই তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছে শিল্প সাহিত্য। আর সম্প্রতি সেই বিষয়টি আরও সংহত হয়ে উঠেছে রাম ও রামকথাকে কেন্দ্র করে। এর আগেও বরোদার স্কুলে এক শিক্ষিকা রামায়ণকে ‘অলীক’ বলায় শোরগোল উঠেছিল। রামকে ‘অপমান’ করেছেন, এই অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন পঞ্জাবের এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকাও। অর্থাৎ, শাসকের তরফে রামকে কেন্দ্র করে যে ভক্তির জোয়ার দানা বেঁধে উঠেছে, তার বাইরে অন্যরকম মত প্রকাশ করার পরিসরটি ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সমাজে রাজনীতির কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রেও যে মতের বহুমাত্রিকতাকে এমন এক ছাঁচে গড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে এক লক্ষ্মণরেখার মতোই। তা মুক্তচিন্তার, মতের স্বাধীন বিচরণের পথটিকেই রুদ্ধ করে দিতে পারে।
আরও শুনুন:
কৃষক আন্দোলন 2.0! ভোটবাক্স কি আদৌ শোনে ফসলের কান্না?
আসলে, চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে একমাত্রিকতা জারি করতে চাইলে তা তো কেবল ব্যক্তিমানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে আসে না, তার জন্য প্রতিষ্ঠানকে নজরদারির আওতায় আনাও জরুরি। আর তাই, সবসময়েই শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে নজর থাকে যে কোনও শাসকের। পাঠক্রম থেকে পাঠদানের ধরন, সবকিছুর মধ্যেই আস্তে আস্তে কায়েম হতে থাকে শাসকের সুরটিই। এ দেশেও সাম্প্রতিক কালে স্কুল-কলেজের সিলেবাসে যে পরিবর্তনগুলি আনা হচ্ছিল, তার প্রেক্ষিতে ওই অভিসন্ধিই খতিয়ে দেখছিলেন অনেকে। সে দলিত লেখকদের লেখা বাদ দেওয়াই হোক, কিংবা রবীন্দ্রনাথের লেখা সরানোই হোক, অথবা মুঘল আমলের ইতিহাস মুছে ফেলতে চাওয়াই হোক। এই সবকিছুই আদতে শাসকের অপছন্দের স্বরকে নাকচ করার একেকটি ধাপ কি না, উঠছিল সে প্রশ্ন। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ফের সে আশঙ্কাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।