সুপ্রিম কোর্টে বদলে গেল লেডি জাস্টিসের চিরচেনা মূর্তি। খুলে গেল আইনের দেবীর চোখের বাঁধন। তবে আইনের দেবীর মূর্তি বদলের সঙ্গেই কি বদলে গেল আইনের দৃষ্টির অর্থ?
পরাধীনতার দুশো বছর পেরিয়ে স্বাধীনতার অমৃতকালে পৌঁছে গিয়েছে দেশ। এবার ঔপনিবেশিক ছাপ মুছে ফেলার পালা। যেভাবে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বদলে গিয়েছে ন্যায়সংহিতায়, সেভাবেই লেডি জাস্টিসের চেনা মূর্তি বদলে তাতে ভারতীয় ছোঁয়া আনার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন খোদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। আর তাঁর সুপারিশ মেনেই শীর্ষ আদালতের লাইব্রেরিতে বসেছে লেডি জাস্টিসের নতুন মূর্তি। যার এক হাতে ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লাটি বজায় থাকলেও, অন্য হাতে তরোয়ালের বদলে উঠে এসেছে সংবিধান। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন মূর্তিতে খুলে গিয়েছে আইনের দেবীর চোখের বাঁধন। আর সেখান থেকেই প্রশ্ন, আইনের দেবীর মূর্তি বদলের সঙ্গে কি সত্যিই বদলে গেল আইনের দৃষ্টির অর্থ?
বিচারের প্রতীক হিসাবে গোটা দেশেই ব্যবহৃত হয় এই লেডি জাস্টিসের মূর্তি। এতদিন কাপড়ে বাঁধা ছিল আইনের দেবীর মূর্তিটির দু’চোখ। এই বাঁধনের অর্থ ছিল নিরপেক্ষতা। অর্থাৎ আইন যে নিরপেক্ষভাবে সবার জন্য সমান ন্যায়বিচার বরাদ্দ রেখেছে, কোনোরকম পরিচিতির সুবাদে সে কাউকে বেশি বা কম সুবিধা দিতে রাজি নয়, সে কথাই বোঝানো হত। আদালতে বিভিন্ন মামলায় যেভাবে প্রভাবশালী তত্ত্ব টানা হয়, প্রভাব খাটিয়ে কারও কারও আইনকে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, সেখানে এই বিষয়ের তাৎপর্য আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, আইনের দরবারে সকলের সমান বিচার মেলে না। যে বিলকিস বানো দিনের পর দিন আইনের দরজায় ঘুরেছেন, তারপরেও তাঁর ধর্ষকেরা জামিন পেয়েছে এবং তাঁকে ফের আইনের দরজায় মাথা ঠুকতে হয়েছে, তিনি কি আইনের দেবীর নিরপেক্ষতায় আস্থা রাখতে পেরেছেন? যেসব দুর্নীতি, ধর্ষণ, অত্যাচারের ঘটনা আমাদের আমূলে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেখানে তাহলে জাস্টিস চেয়ে গলা ফাটাতে হচ্ছে কেন? বর্তমান যুগে একাধিকবার প্রশ্ন উঠেছে, চোখ বন্ধ রেখে কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন বিচারের দেবী? অনেক বিষয় কি বিচারব্যবস্থার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে? আর সেই ভাবনা থেকেই বদল এসেছে লেডি জাস্টিসের মূর্তিতে। চন্দ্রচূড় নিজেই এ কথায় জোর দিচ্ছেন যে, আইন অন্ধ নয়, সে সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখে।
কিন্তু গান্ধারীর চোখ বাঁধার কথা যে ভারতীয় সমাজ জানে, তার কাছে তো এ কথা নতুন নয় যে চোখ বন্ধ করাও আসলে সমদৃষ্টির প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। হয়ে উঠতে পারে নিরপেক্ষতার বয়ান। মহাভারতই বলেছে, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় বর্ষীয়ান বিচক্ষণ পুরুষেরা চোখ মেলে সে অনাচার দেখেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়েও তাঁরা চোখ মেলেই ছিলেন, তবুও অন্যায় যুদ্ধ হয়েছে। অথচ চোখ বেঁধে থাকা গান্ধারী তাঁর পুত্রদের জয় চাইতে পারেননি, বলেছেন ধর্মের জয় হোক। সুতরাং, সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখা যে আসলে একরকমের মানসিকতা, চোখের বাঁধন থাকা না-থাকার সঙ্গে তার কোনও যোগ নাও থাকতে পারে, সে কথা তো আমাদের না-জানা নয়। এর আগে যেমন ‘অন্ধা কানুন’ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, তেমনই এ কথাও সত্যি যে সেই সময়েই একাধিক যুগান্তকারী রায়ও ঘোষণা করেছে দেশের আদালত। সাম্প্রতিক কালের তিন তালাক রদের কথাই ধরা যাক না। আইনের দেবীর চোখ বাঁধা ছিল বলেই আইন অন্ধ ছিল, এ কথার ইঙ্গিত দিলে সেই পদক্ষেপগুলি নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। আবার আইনের দেবীর চোখ খোলা হলেই সমস্ত দুর্নীতি-ধর্ষণ-অনাচারের স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার হবে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ আশ্বাসেও কি আমরা থিতু হতে পারব?
সুতরাং আইনের দেবীর চোখ বাঁধাই থাক বা খোলা, সেই বাহ্যিক বদলের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আইন সকলকে সমদৃষ্টিতে দেখবে এই আশ্বাস। প্রধান বিচারপতির কথা থেকে কিন্তু মনে হয়, লেডি জাস্টিসের বন্ধ চোখ যে নিরপেক্ষতার বার্তা দিয়ে এসেছে এতদিন, বর্তমানের খোলা চোখের দৃষ্টিও সেই একই অর্থ বহন করছে। মূর্তি বদল হোক বা না হোক, সেই দৃষ্টির বদল না হওয়াই দেশের কাছে কাম্য।