প্রায় দু’বছর ধরে জেলবন্দি সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান। গোটা দেশ ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলেও, মুক্তি মেলেনি সাংবাদিকের। কিন্তু তাতে কী! সাংবাদিক হয়ে যে সত্যের কথা, নাগরিকদের যে অধিকারের কথা তিনি বলতে চান, তাই-ই যেন বলে উঠল তাঁর ন-বছরের ছোট্ট মেয়ে মেহনাজ। দেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার পক্ষেই সওয়াল করল সে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক তাঁর কথা।
“আমি সেই সাংবাদিকের মেয়ে, যাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে কারাগারে। শুধু তাই নয়, একজন ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য সমস্ত মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে তাঁকে।” – খুদে হাতে মাইক ধরে এই কথাগুলোই বলছিল ন-বছরের ছোট্ট মেয়ে মেহনাজ। স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষেই তার এই সমস্ত কথা বলা। সাধারণ বলে যাওয়া কথা মাত্র নয়। কেননা মেহনাজের পরিচয়ই তাকে, তার বয়সি আর-পাঁচটা খুদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের মেয়ে। হাথরস কাণ্ডের পর থেকে জেলবন্দি যে সাংবাদিক। তবে বাবার বন্দিদশা একরত্তি মেয়েটির মুখের কথা, অন্তরের সাহস কেড়ে নিতে পারেনি। সোচ্চারে সে বলে গিয়েছে, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকারের কথা। আর তার বলা সেই কথাগুলোই আন্দোলিত করেছে সকল দেশবাসীকে।
আরও শুনুন: অন্য মহিলাদের সঙ্গে স্ত্রীর তুলনা টেনে বিদ্রুপ অপরাধের শামিল, সাফ জানাল আদালত
সেই ২০২০ সালে বন্দি করা হয়েছিল মেহনাজের বাবাকে। যোগীরাজ্যে তখন ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ এক ঘটনা। হাথরস ধর্ষণকাণ্ডে তোলপাড় গোটা দেশ। ওই হাথরসে যাওয়ার পথেই পুলিশের হাতে আটক হন সিদ্দিক কাপ্পান। তাঁর বিরুদ্ধে সেই মধ্যযুগীয় ইউএপিএ আইনে মামলা রুজু হয়। যে আইনের বৈধতা নিয়ে পরে বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। আইনের অবলোপ চেয়ে সোচ্চার হয়েছেন তাবড় নেতারা। এমনকী বিতর্কের জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। কিন্তু সেইসব বিতর্ক কারাগারের অন্ধকারে কাপ্পানের জন্য নতুন কোনও আলোর সন্ধান হয়ে নেমে আসেনি। দু-বছর পরেও তিনি বন্দি-ই। সেই সিদ্দিক কাপ্পানের কন্যা মেহনাজ যেন হাতে তুলে নিয়েছে বাবার ব্যাটনই। যে-কটা কথা সে বলেছে, অনেকেই মনে করছেন, বর্তমান ভারতবর্ষে সে-কথা বলা যেমন প্রাসঙ্গিক, তেমন তা বলতে সাহসও লাগে। মেহনাজ বলেছে, “প্রত্যেক ভারতীয়ের অধিকার আছে তাঁরা কী বলবেন, কী খাবেন এবং কোন ধর্ম তিনি গ্রহণ করবেন। আর এই অধিকার মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, ভগৎ সিংহ-সহ অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা অর্জন করেছেন।” সেইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষের থেকে স্বাধীনতা এবং অধিকার কেড়ে না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে মেহনাজ। মাত্র দু’মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বাবার কথা ছুঁয়েই দেশের প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকারগুলির পক্ষে সওয়াল করেছে মেহনাজ।
আরও শুনুন: বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্তিতে চলল মিষ্টি বিতরণ, কী বলছেন বিলকিসের স্বামী?
এখানেই থামেনি সে। সংক্ষিপ্ত পরিসরেও মেহনাজ মনে করিয়ে দিয়েছে, দেশে জারি থাকা অশান্তির পরিবেশের কথাও। ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংসার আশ্রয়ে প্রতিবেশ যে অশান্ত করে তোলা হচ্ছে, এ-কথাও বলেছে সে। এই সমস্ত অন্যায়কে ভালবাসা এবং একতার মাধ্যমে উপড়ে ফেলতে হবে বলেই বিশ্বাস করে ছোট্ট মেয়েটি। সে এমন এক আগামীর স্বপ্ন দেখে, যেখানে এইসব ভেদাভেদ আর অশান্তি একদিন মুছে যাবে। যেখানে নাগরিক অধিকারগুলির নাগাল পাবে দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষ। ভারতমাতার জয় ঘোষণা করে সেই স্বপ্নের কথাতেই নিজের বক্তব্য শেষ করেছে সিদ্দিক কাপ্পানের কন্যা।
পঁচাত্তর পেরনো স্বাধীনতা মুক্তির বার্তা শোনাতে পারেনি সিদ্দিক কাপ্পানকে। তবু তাঁর ছোট্ট মেয়ে যে ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখে, যে-কথা সে বলে ফেলতে পারে অকুতোভয়ে- তাই-ই বোধহয় একান্তে উড়িয়ে দেয় মুক্তির পতাকা।