প্রধানমন্ত্রী ধ্যানে বসছেন সেই কন্যাকুমারী-তে। ঢেউ এসে লাগতে পারে নাকি এই বঙ্গে। কান টানলে মাথা আসার মতোই নাকি ধ্যানে বসলে ভোট আসে। কিন্তু কেন এমন ধারনা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের? আসুন সে কথায় কান পাতা যাক।
এ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ! না, ছোটগল্প নয়, ভোটের প্রচার। আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ দফার প্রচারপর্ব যখন শেষ হচ্ছে, তখনই ধ্যানে বসছেন প্রধানমন্ত্রী। এ কাজ তিনি আগেও করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ বিস্মিত হয়েই খেয়াল করেছিলেন যে, প্রচার ফুরিয়েও যে ফুরোয় না, তা তিনি হাতেকলমে করে দেখাতে পারেন। যদিও তাতে আইনত কোনও বাধা নেই। গোটা দেশ এমন অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী থেকেছে বলেই, এবার মোদি-মেডিটেশনের খবর পেয়েই ফুঁসে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, যদি ওই ধ্যানের সম্প্রচার হতে তিনি দেখেন, তো কমিশনে নালিশ ঠুকবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ রকে বসেই কেন ধ্যান করবেন মোদি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তারও একটা সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করেছেন।
আধ্যাত্মিকতার যাত্রাপথ খেয়াল করলে, এই শিলাখণ্ডের তাৎপর্য বেশ অনুধাবন করা যায়। স্বয়ং পার্বতী নাকি এখানে বসেই শিবের ধ্যান করেছিলেন। তাই এই জায়গার নাম কন্যাকুমারী। সেই পৌরাণিক তাৎপর্যে নতুন মাত্রা সংযোজিত হল স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে। ভুবন ভ্রমিয়া শেষে তিনি এইখানে এসেই ধ্যানে বসেছিলেন। অন্তরের সত্য উপলব্ধির জন্য। লক্ষ্যণীয় যে, স্বামীজি এখানে তিন দিন ধ্যান করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যে ধ্যানের কর্মসূচি নিয়েছেন, তাও ওই তিন দিনেরই। এখন, স্বামীজির নাম জড়িয়ে থাকার জন্যই দেশের শেষ প্রান্তের এই অংশের সঙ্গেও বাংলার আত্মিক যোগ বেশ নিবিড়। তাঁকে স্মরণ করেই একটি সৌধ তৈরি হয়েছিল কন্যাকুমারীতে। তখন অবশ্য কংগ্রেস আমল। সেই সৌধের সঙ্গে অনেকটাই আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখা যায় বেলুড় মঠের। অর্থাৎ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ঘরানার মঠ যেমন দেখতে হয়, বাংলা থেকে বহদূরে কন্যাকুমারীতে যেন তারই এক সংস্করণের দেখা গেল। ঘটনাচক্রে ঠিক সেখানেই ধ্যানে বসছেন মোদি। যদিও তিনি বলছেন যে, আধ্যাত্মিকতার খোঁজেই তাঁর এই ধ্যানের ধর্ম পালন। তবে, পুরো বিষয়টিকে আর কাকতালীয় হিসাবে দেখছেন না বিশ্লেষকরা। কেননা তা ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছে বাংলার ভোটের সঙ্গে। শেষদফায় বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট চলবে। ঠিক সেই সময়েই বাংলার আবেগমথিত স্থানে প্রধানমন্ত্রীর ধ্যানের সিদ্ধান্ত যে ভোটের খাতায় একেবারে প্রভাব ফেলবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
আরও শুনুন:
রামের দোকান আগলান খায়রুল, এক ঠোঙায় খান মুড়ি, বাংলা আজও ভালোবাসার বারান্দা
অনেকেই বলছেন, এই যোগাযোগ খুঁজে দেখতে গেলে ভোটের বেলাশেষে, বেলাশুরুর দিকে আর একবার ফিরে তাকাতে হবে। এবার শুরুতেই চারশো পারের স্লোগান দিয়েছিল বিজেপি। বিরোধীরা প্রায় এক কথায় তা নস্যাৎ করে দিয়েছিল। অনেকেই খতিয়ে দেখছিলেন, অঙ্কটা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। যদি এই টার্গেটে পৌঁছতে হয় গেরুয়া শিবিরকে, তাহলে যে অঞ্চলে তাদের আসন সংখ্যা কম, সেখানে আসন বিপুল সংখ্যায় বাড়াতে হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশের কথা ছেড়ে দিলে, এই অঙ্ক মেলানোর জায়গা হয়ে ওঠে পূর্ব এবং দক্ষিণ। সেই সূত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাংলা। অথচ এখানে বিরোধিতার শক্তি এতটাই প্রখর যে, গত বিধানসভায় শত চেষ্টা করেও হার মানতে হয়েছিল বিজেপিকে। ‘১৯-এর লোকসভায় যে প্রায় অপ্রত্যাশিত সাফল্য এসেছিল, তার-ই জের খানিকটা জিইয়ে রাখতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। তবে তা সফল হবে কি হবে না, তা আলাদা প্রশ্ন। তবে, সে যুদ্ধে শান দিয়ে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। শেষদফার প্রচারে রাজ্যে এসে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তো তুলেইছেন। তার উপর ইন্ডিয়া জোট আর জামাত-কে এক বন্ধনীতে তুলে এনেছেন। এই ধরনের মন্তব্য যে বিদ্বেষমূলক, তা নিয়ে সরব হয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস। চিঠি গিয়েছে কমিশনেও। তবে, সারকথা এই যে, বঙ্গের ভোট বাড়াতে মোদির চেষ্টা প্রায় ক্লান্তিহীন। ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই বিবেকানন্দের স্মৃতিবিজড়ির শিলাখণ্ডে তাঁর ধ্যানে বসার সিদ্ধান্ত অন্য তাৎপর্য বয়ে এনেছে রাজনৈতিক মহলে। শেষবেলায় ভোট বাড়ানোর শেষ চেষ্টাটুকুর ইঙ্গিত রয়ে গিয়েছে এই সিদ্ধান্তে। তবে শুধু বাংলাই নয়, এর সঙ্গে জুড়ে আছে দক্ষিণও। এবারের ভোটে দক্ষিণে পদ্মশিবিরের প্রভাব-প্রতিপত্তি আদৌ বাড়বে কি-না, তা নিয়ে এর মধ্যেই বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, আসনের অঙ্কে প্রতিফলিত না হলেও, সেখানে বিজেপির ভোট পার্সেন্টেজ খানিকটা বাড়তেই পারে। অতএব এক সিদ্ধান্তে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণকে জুড়ে নিতে পারলেন মোদি। তবে, আসনের সেই পুরনো টার্গেটের অঙ্কটা ধরলে, মূল লক্ষ্য যে বাংলার ভোটের আবেগকে প্রভাবিত করা, এমনটা মত অনেকেরই।
অতএব এ সিদ্ধান্ত শুধুই আধ্যাত্মিক নাকি রাজনৈতিক? সে বিচারের ভার অবশ্য বঙ্গবাসীরই।