লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে জিডিপি বৃদ্ধির হারে সুখবর শুনিয়েছে কেন্দ্র। জিডিপির সঙ্গে কাজের বাজারের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সে কথা তো জানাই। কিন্তু এই বৃদ্ধি কি সত্যিই দেশের কর্মসংস্থানের দুনিয়াতেও আশা জাগাল? নাকি এর নেপথ্যে রইল অন্য কোনও অঙ্কও? শুনে নেওয়া যাক।
লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই জিডিপি বৃদ্ধির হারে আশার আলো। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের দাবি অনুযায়ী, ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। যা সাম্প্রতিক অতীতে সর্বাধিক। জিডিপি বৃদ্ধির কথা জানিয়ে সোশাল মিডিয়ায় দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর কথায়, “দেশের ১৪০ কোটি মানুষ যাতে আরও ভালো জীবনযাপন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমরা আরও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি করার চেষ্টা করব।” তাঁর এই কথার প্রেক্ষিতেই কথা ওঠে, জিডিপির বৃদ্ধি কীভাবে আমজনতার জীবনে ছাপ ফেলছে, কীভাবে তাদের জীবনযাপনের উন্নতি ঘটাচ্ছে, সে কথা খতিয়ে দেখাও জরুরি। আসলে শ্রমের উপর নির্ভর করে যে জিডিপির হার বাড়ে কমে, সে কথা তো জানাই। আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষই যেহেতু পুঁজি কিংবা জমির মালিক নন, শ্রমের সূত্রেই তাঁরা আয় করেন, সুতরাং জিডিপি বৃদ্ধির হার সেই শ্রমের সংস্থান বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। সোজা কথায়, জিডিপি বৃদ্ধির হার আশাজনক মানে কাজের বাজারের পরিস্থিতি ভালো, আপাত চোখে এমনটাই মনে হওয়ার কথা। ভোটের আগে যেখানে অর্থনীতির বেহাল দশা আর বেকারত্বকে হাতিয়ার করে আক্রমণ শানাচ্ছিল বিরোধীরা, সেখানে এই নয়া পরিসংখ্যান কেন্দ্রের পালে বাড়তি হাওয়া জোগাবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কিন্তু নেপথ্যের ছবিটা কি একই কথা বলছে?
আরও শুনুন:
চাকরি নয়, স্বনির্ভর ব্যবসার পথেই নারীর যোগদান বাড়ছে দেশের শ্রমশক্তিতে, জানাল সমীক্ষা
বার্ষিক পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে বা পিএলএফএস-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে পারে যে, সত্যিই উন্নতি ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, শ্রমের বাজারের দুটো মূল সূচক হল বেকারত্বের হার এবং শ্রমের বাজারে যোগদানের হার, অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম বয়সের মোট জনসংখ্যার মধ্যে যত শতাংশ শ্রমের বাজারের সঙ্গে যুক্ত। দেখা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ সালে শ্রমের বাজারে যোগদানের হার ছিল ৫২.৩৫%, ২০২১-২২ সালেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৩৫%। যা আপাতভাবে ভালো খবর। এর আগেই দেশের জিডিপি কমে যাওয়ার আবহে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া দাবি করেছিল, নারীদের গৃহশ্রমের হিসেব ধরলে বাড়ত দেশের জিডিপি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা আগের তুলনায় অনেক বেশি কাজের বাজারে যোগ দিতে চাইছেন। যা নারীমুক্তির ক্ষেত্রেও বাঁকবদল বলে গণ্য হতে পারে।
আরও শুনুন:
৭০ ঘণ্টার থেকেও বেশি কাজ করে মেয়েরা, কথা হয় না তো! কটাক্ষ রাধিকার
কিন্তু কাজ তো একরকম নয়। সেখানে নিয়মিত মজুরি বা বেতনের কাজ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ঠিকা কাজ এবং স্বনিযুক্তি। বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, নিয়মিত বেতন মিলবে এমন কাজের বৃদ্ধির হার সামান্য, আসলে বেড়েছে পারিবারিক ক্ষেত্রে অবৈতনিক শ্রমে নিযুক্তদের হার। এমনকি মেয়েদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির একটা বড় জায়গাও এই ক্ষেত্রটিই। অর্থাৎ নিয়মিত বেতন মিলবে, এমন কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে কম। দেশের মোট বাসিন্দার তুলনায় কর্মসংস্থানের অনুপাত আশানুরূপ নয় বলেই অনেক মানুষকেই ঠিকে কাজ বা স্বনির্ভর কাজের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এর ভিত্তিতেই CMIE তথা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি-র অধিকর্তা মহেশ ব্যাস স্পষ্ট বলছেন, ভারতের ওয়ার্কফোর্স, অর্থাৎ এমপ্লয়েড নাগরিকের সংখ্যা আদৌ বাড়ছে না। সব মিলিয়ে, দেশে কাজের সার্বিক গুণগত মান কমেছে, সাফ জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই কারণেই অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের সার্বিক আয়বৃদ্ধি আশা জাগাতে পারে বটে, কিন্তু আমজনতার একটা বড় অংশই যদি সেই বৃদ্ধির শরিক না হয়ে উঠতে পারেন, সেখানে কিন্তু জমে থাকছে অন্ধকারই।