যজ্ঞশিখায় লেখা আছে প্রার্থনা- সফল হোক। নমাজের নীরবতাতেও লেখা সেই একই প্রার্থনা- সফল হোক। প্রার্থনা করছে বারাণসী, লখনউ, কর্নাটক। প্রার্থনা করছেন পুরোহিত থেকে ইমাম। কোটি কোটি দেশবাসী সকলেই। আর সেই প্রার্থনার ভিতর দিয়ে ফুটে উঠছে আবহমানের এক ভারতবর্ষ। যে ভারতবর্ষ সম্প্রদায়গত ভাবে ভিন্ন, তবু আত্মার সূত্রে এক। যেখানে বিভেদ পেরিয়ে জেগে থাকে বৃহত্তর মানবতা। চন্দ্রযানের জন্য সাফল্য প্রার্থনা যেন দেশের সম্প্রীতির শিখাটিকেই আরও একটু উজ্জ্বল করল।
মেলাল সে মেলাল। চাঁদের ওপিঠে নামার আগে মিলিয়ে দিল গোটা ভারতবর্ষকে। সম্প্রদায়ের ভিতর-ভিতর যে সম্প্রীতির যোগসূত্র, মহাকাশ থেকে যেন ভাররবাসীর মনে-মনে সেই সুতোটিই বেঁধে দিয়েছে ‘চন্দ্রযান-৩’। রাখির আগেই অপূর্ব এক রাখিবন্ধন। আর তাই তো দিকে দিকে প্রার্থনার শান্ত ছবিতে ধরা পড়ছে চিরকালের এক ভারতবর্ষ- জনগণমনের ভারতবর্ষ।
অথচ কে বলবে, এই দেশের মাটিতেই বহাল তবিয়তি আছে বিভেদের সহস্র ফাটল। পদ পদে সাজিয়ে রাখা বিদ্বেষের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে মানুষ। মূল ইন্ধনদাতা অবশ্যই বিদ্বেষকামী রাজনীতি। সে মানুষকে ক্রমশ খাটো করতে চায়। মানুষে-মানুষে মিলে যে বড় সভ্যতার কথা আমরা কল্পনা করি, তাতেই এই বিশেষ ধরনের রাজনীতির সবিশেষ আপত্তি। সে মুখে বলে বসুধৈব কুটুম্বকম্ – অর্থাৎ গোট পৃথিবীই যেন একটা পরিবার। কিন্তু কাজে তা ধারে না। বরং গোষ্ঠীর অহং, সম্প্রদায়ের ভিতর ক্ষমতার নেশা জাগিয়ে সে মানুষের চারপাশে তুলে দেয় ছোট ছোট প্রাচীর। যত খণ্ড মানুষ, তত সে দুর্বল। যত তার ভিতরের দুর্বলতা তত সে সম্প্রদায়, গোষ্ঠী আঁকড়ে ধরে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নামে। আর তাতেই বাড়ে হিংসা, গোষ্ঠী-সংঘর্ষ। নৃশংসতা এসে ঘিরে ধরে আমাদের। সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে তারই বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে।মণিপুর থেকে কর্ণাটক- বিরাম নেই এই সংঘর্ষের। বিশেষত হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ প্রায়শই শিরোনামে উঠে আসে। তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়, চর্চা হয়। আত্মিক মেলবন্ধনের দিকে জোর দিতে বলেন বিশেষজ্ঞরা, কিন্তু বিদ্বেষক্লান্ত পরিবেশে সেই পথটি যে ঠিক কোথায়, তা যেন কেউই খুঁজে পায় না।
ঠিক সেই পরিবেশটাই যেন ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে মুছে দিল ‘চন্দ্রযান-৩’। ভারতের মহাকাশ গবেষণার মাইলফলক মুহূর্ত। বহু বিজ্ঞানীর স্বপ্ন, পরিশ্রম মিশে আছে এই প্রকল্পে। সাফল্য অবশ্য শুধু তাঁদেরই নয়, এ সাফল্যের অমল অমৃত ঝরে পড়বে সকল দেশবাসীর উপরেই। আর তাই বারাণসী থেকে কর্ণাটক- মন্দিরে মন্দিরে হচ্ছে যজ্ঞ। পবিত্র অগ্নিশিখায় যেন দেশবাসীর মনস্কামনা। লখনউয়ের ইদগাহে ছোটরা নমাজ পড়েছে, দোয়া করেছে একই সাফল্যের জন্য। প্রার্থনার ছবি আজমের শরিফেও। চাঁদের দিকে চোখ রেখে হাতে হাত হিন্দু ও মুসলমান ভারতবাসীর। কে বলবে তাঁদের পারস্পরিক লাঠালাঠির খবরে বছরভর ছেয়ে থাকে সংবাদমাধ্যম!
আসলে এটাই তো আমাদের ভারতবর্ষ। যেখানে বহু মতের মানুষের বাস। সেই পার্থক্য স্বীকার করে নিয়েও, দেশের সূত্রে সকলেই এক, বিদ্বেষ নয়, বিভেদ নয়, বৈচিত্রের সূত্রে এক হয়ে থাকাই আমাদের দেশের আত্মার বাণী। সময়ে-সময়ে আমরা তা ভুলে যাই। কিংবা রাজনীতি আমাদের মিলিয়ে দেয়। শুধু চাঁদের ওপিঠে যে অন্ধকার তা নয়, জমাট অন্ধকার দেশবাসীর মনেও। চন্দ্রযানের জন্য সাফল্য প্রার্থনার মুহূর্ত যেন সেই অন্ধকার মুছেই এনে দিল আলো- সম্প্রীতির আলো।
চাঁদের ওপিঠের যে ছবি পাওয়া যাবে, তা তো এগিয়ে দেবে ভারতকে। তবে, সেই সূত্রে সম্প্রীতির যে ছবি ফুটে উঠল তা-ও কিন্তু কম মূল্যবান নয়। বড় লক্ষ্যের জন্য এই একতার নামই- ভারতবর্ষ। সুতরাং আজকে ভাস্বর এই ছবিটি যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, তবে আখেরে এগিয়ে যাবে গোটা ভারতবর্ষই। চন্দ্রযানের দৌলতে যে দুর্লভ মুহূর্ত হাতে পেয়েছি, তাই-বা আমরা হাতছাড়া হতে দেব কেন!