সুরের ভাষা আর ছন্দের ভাষায় ‘উঁচা নীচা ছোট বড়’ সকলে সমান হয়ে যায়, গান গেয়েই এ কথা শিখিয়েছিল গুপী-বাঘা। কিন্তু সমদর্শিতার বদলে বিভেদের বিষ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠবে সেই গান-কবিতাই, এমন কথা সেদিন ভাবনার বাইরে ছিল। এখনকার ভারত কি সে কথাই ভাবছে? তেমনই প্রশ্ন উসকে দিল সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। শুনে নেওয়া যাক।
যে কোনওরকম হিংসা-বিদ্বেষের মুখে দাঁড়িয়ে একরকম নিরস্ত্র প্রতিবাদের বয়ান লিখতে পারে গান, এ কথাই জানতাম আমরা। ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’ ছবিতে দেখা গিয়েছিল, নাৎসি জার্মানির আগ্রাসনের মাঝে দাঁড়িয়ে সুরের ভাষাতেই জারি থাকছে প্রতিবাদ। কারণ সুরের রয়েছে এক নিজস্ব ভাষা, যা সকলকে সমস্ত বিভেদ মুছে এক সুতোয় বাঁধতে পারে। দাঁড় করাতে পারে একই সমতলে। তাই রাজসভায় দাঁড়িয়ে মেঠো গানের সুরেই গুপী গাইন আর বাঘা বাইন বলেছিল, “ভাষা এমন কথা বলে বোঝে রে সকলে/ উঁচা নীচা ছোট বড় সমান”। সত্যি বলতে, ভারতবর্ষের সামগ্রিক সংস্কৃতির মধ্যেই তো জেগে ছিল এই কথা যে, সুর-ছন্দ-ছবি আসলে সমতার কথা বলে, সমদর্শিতার কথা বলে। সমস্ত বিভেদের উপরে যা বিছিয়ে দেয় সামঞ্জস্যের আস্তরণ, আর সেই কারণেই তা সুন্দর। কিন্তু এ কালের ভারত বুঝি আর সে কথা বলছে না। বরং সম্প্রতি সেখানে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটা উলটো ছবি। যেখানে ভালোবাসার বদলে ঘৃণার ভাষা বুনছে গান। আর সুরের ভাষা সকলে বোঝে বলেই তা চারিয়েও যাচ্ছে দেশের কোণে কোণে। আর এই নয়া হাতিয়ার ব্যবহার করেই ক্রমশ ঘৃণা আর বিদ্বেষকে ‘স্বাভাবিক’ তকমা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।
আরও শুনুন:
সরস্বতীর পোশাকে বিতর্ক! আদিতে ভারতীয় মহিলারা কি শাড়ি পরতেন?
“সুর যদি ভালবাসার রসদ জোগায়, তবে বাজাতে থাকো, বাজাতে থাকো, বাজাতেই থাকো।”- এমন কথা বলেছিল শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটক ‘টুয়েলফথ নাইট’। কিন্তু সুরের মধ্যেই যে ভালোবাসার জায়গা জুড়ে বসছে ঘৃণা। অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা। আসলে ক্ষমতাতন্ত্র সবসময়েই নিজের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে দুরকম হাতিয়ার ব্যবহার করে- এক, খোলাখুলি দমননীতি, আর দুই, আদর্শগত নিয়ন্ত্রণ বা আইডিয়াল স্টেট অ্যাপারেটাস। এই দ্বিতীয় পথে হেঁটেই গান-কবিতাকে ক্রমশ হাতিয়ার করে নিচ্ছে বিভেদের রাজনীতি। দেখা যাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে জন্ম দেওয়া হচ্ছে এক নতুন সংস্কৃতির, যেখানে গান-কবিতার মতো উপাদানগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যেকার বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দিতে। যেমন, হরিয়ানার বছর ত্রিশের পপ-তারকা কবি সিংহের গলায় ‘অগর ছুয়া মন্দির তো তুঝে দিখা দেঙ্গে’ ভাইরাল হয়ে গিয়েছে নিমেষে। ‘হর ঘর ভাগোয়া ছায়েগা’ গানে রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলা হচ্ছে, “হিন্দু কো না কমজোর সমঝনা/ ইয়ে দুশমন কি ভুল হ্যায়”। ডিজে-সহযোগে হিন্দুত্ব-পপ বা এইচ-পপ গানও কম বিষ ছড়াচ্ছে না। আবার উত্তরপ্রদেশের গ্রাম-মফস্সলের অজস্র কবিসভায় ঘুরে ঘুরে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কমল আগ্নেয়। এই যুবক কবির লেখা জুড়ে থাকে লাভ জিহাদ, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কটূক্তি, আবার হিন্দুকে বিপন্ন বলে দাগিয়ে তার জন্য লড়াই করার ডাক। তাঁর গান্ধি-বিদ্বেষী ও গডসের প্রশস্তিবাচক কবিতা শুনে নিজের গলার মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন যতি নরসিংহানন্দ, যিনি নিজেও ঘৃণাভাষণের জেরে শিরোনামে এসেছেন। সম্প্রতি ‘এইচ-পপ… দ্য সিক্রেটিভ ওয়ার্ল্ড অফ হিন্দুত্ব পপ স্টারস’ বইয়ে সাংবাদিক কুণাল পুরোহিত ব্যাখ্যা করেছেন, এহেন উসকানিমূলক গান কীভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিসর মসৃণ করে দিচ্ছে। আর তা এই কারণেই হচ্ছে, কারণ গান-কবিতার মাধ্যমে ওই বিদ্বেষ রাজনৈতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে জনমানসে ছড়িয়ে পড়ছে। আমজনতার একটা বড় অংশ ক্রমশ একে স্বাভাবিক বলেই ভাবতে শিখছে। অর্থাৎ, ক্রমে ক্রমে গণসম্মতি আদায় করে নিচ্ছে এই খোলা বিভেদের বয়ান।
আরও শুনুন:
রামচরিত: রায়সাহেবের রামদর্শন– থাকেন ‘জটায়ু’, দুষ্টু লোকের পাশেই চলে রামের ভজন
গোড়ায় কোনও একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ বা কোনও রাজনৈতিক শিবির এক শ্রেণির মানুষকে ‘অপর’ বলে দাগিয়ে দিয়েছিল। রাজনৈতিক স্লোগানে-বক্তৃতায়-লিফলেটে-দেওয়াল লিখনে সেই বয়ানকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সেখানেই সীমাবদ্ধ না থেকে এই যে সাধারণের ভাষায় ক্রমশ ঢুকে পড়ল সেই বয়ান, আর সাধারণের তরফে তাকে সেই অনুপ্রবেশের অনুমতিও দেওয়া হল সহজেই- এ থেকেই আশঙ্কা জাগে, তবে কি পুরোপুরিই পালটে যাচ্ছে গুপী-বাঘার দেশ?