প্রথমে ছিল জয়ের আত্মবিশ্বাস। যে বিশ্বাসে ভর করেই ৪০০ পার-এর স্লোগান তুলেছিল বিজেপি। লোকসভা শুরু হয়ে যেতে সে স্লোগান জারি রইল বটে, তবে তার মানে বদলাচ্ছে ক্রমশ। এক মাসের ৬০ বক্তৃতায় কীভাবে ৪০০ পার-এর স্লোগানকে নয়া চেহারা দিলেন মোদি? শুনে নেওয়া যাক।
মার্চ থেকে এপ্রিল মাস। একেবারে লোকসভা ভোটের গরম হাওয়া বইছে যখন, ঠিক সেই সময়। এই গোটা সময়টা জুড়েই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সভা করে ফিরছেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনী প্রচারে এক মাসের মধ্যে অন্তত ষাটখানা বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেছেন তিনি। আর প্রায় প্রত্যেক বক্তৃতাতেই এসেছে চারশো আসন পার করার প্রসঙ্গ। কিন্তু ভোট এগোতেই যেন বদলে যাচ্ছে ‘৪০০ পার’ স্লোগানের অর্থ। আর তা বদলে দিচ্ছেন খোদ মোদিই। তাঁর প্রায় ষাটটি বক্তব্য খতিয়ে দেখে এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
আরও শুনুন:
মঙ্গল-অমঙ্গলসূত্র! দুর্নীতিকে দূরে ঠেলে ভোট যেন সেই ‘ধর্ম’যুদ্ধ
চব্বিশের নির্বাচনের শুরুতেই চারশো আসনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন বিজেপি হাইকমান্ড। ‘আব কি পার চারশো পার’-এর স্লোগানেই সুর বেঁধেছিল গেরুয়া শিবিরও। নির্বাচনের আগেই যুদ্ধে জয় হয়ে গিয়েছে প্রায়, এমন আত্মবিশ্বাসই ফুটে উঠছিল বিজেপির স্লোগানে। সত্যি বলতে, এই মুহূর্তে বিজেপির সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতিকে টেক্কা দেওয়ার মতো জোর বিরোধী শিবিরে খুঁজে পাচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ইন্ডিয়া জোটের অন্দরের টালমাটাল, দলবদলে সেই দুর্বলতাই প্রকট হয়েছে। সব মিলিয়ে তৃতীয়বার মসনদে ফেরা নিয়ে সন্দেহ মাত্র ছিল না বিজেপির ঘরে। যেভাবে সরকার গড়ার পরের পরিকল্পনাও তাঁরা তুলে ধরছিলেন, তাতে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে বিজেপি শিবিরের আত্মবিশ্বাসই ফুটে উঠছিল। কিন্তু প্রথম দফা ভোট পেরোতেই দেখা গেল, সে স্লোগানের সুর বদলে গিয়েছে। চারশো পেরোনোর নিঃসংশয় ঘোষণার বদলে কেন চারশো পেরোনো জরুরি, তার ব্যাখ্যা দিলেন খোদ মোদিই। মধ্যপ্রদেশের সাগরের জনসভা থেকে তিনি বলেন, দলিত, আদিবাসী, ওবিসি-দের সংরক্ষণ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বিরোধীরা। তাদের লুঠ করার চেষ্টা করছে। সেই খেলা চিরতরে বন্ধ করার জন্যই চারশোর বেশি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গড়তে চান মোদি।
কিন্তু কীভাবে এই লুঠ করার পরিকল্পনা করছে বিরোধীরা? এই অভিযোগকে প্রতিষ্ঠা দিতে সম্পদের সমীক্ষা ও পুনর্বণ্টনের কংগ্রেসি প্রস্তাবকে হাতিয়ার করেছেন মোদি। সম্প্রতি হায়দরাবাদে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কোন শ্রেণির হাতে কত সম্পদ আছে তা সমীক্ষা করে দেখবে। সত্যি বলতে, সম্পদের বৈষম্য ঘোচাতে চাইলে এহেন সমীক্ষা করার কথা উঠতেই পারে। কিন্তু সেই বক্তব্যকে টেনে এনে মোদির দাবি, ‘‘অতীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার মুসলিমদের। সেই কারণেই সমীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস। যাতে দেশবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ মুসলিম ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়।’’ তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় এলে মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে কংগ্রেস, আর তারপর তা বিলিয়ে দেওয়া হবে। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারেও মুসলিম লিগের ছাপ রয়েছে বলে আগেই তোপ দেগেছিলেন তিনি। এভাবেই বারে বারে কংগ্রেসকে মুসলিম তোষণকারী বলে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছেন মোদি-সহ বিজেপি নেতারা। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, আসলে মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলেই মোদি হিন্দু ভোটারদের বোঝাতে চাইছেন যে, কেন বিজেপিকে চারশোর বেশি আসন দেওয়া জরুরি।
আরও শুনুন:
মুখে কুলুপ, ভোট চলুক! নীরবতাই হাতিয়ার মুসলিমদের, পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞদের
আসলে প্রথম দফার ভোটের হিসেব বলছে, গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং বিহার, মহারাষ্ট্রে বিজেপির পক্ষে ভোট কম পড়েছে। এমনকি গরমের দাবদাহ সয়েও মুসলিম ভোটারদের মধ্যে যে হারে ভোটদানের প্রবণতা দেখা গিয়েছে, হিন্দু ভোটারদের মধ্যে তা দেখা যায়নি বলেই মনে করছে বিজেপি। তা ছাড়াও বিজেপির অন্দরের বিশ্লেষণ, দলের প্রতি ক্ষোভও রয়েছে কর্মী-সমর্থকদের একাংশের। সব মিলিয়ে শেষমেশ লাভের ঘরে টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর তাতেই নড়েচড়ে বসেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। নির্বাচনের আগেই যুদ্ধে জয় হয়ে গিয়েছে বলে যে ধারণা পদ্মশিবিরে জাঁকিয়ে বসেছিল, কেবল সেই ভরসায় নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার কথা আর ভাবছেন না তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই কারণে প্রচারের তূণ থেকে ফের মেরুকরণের তিরেই শান দিচ্ছেন মোদি। বিজেপির বক্তব্য, ২০১৯-এ প্রথম দুটি পর্বেই দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বিজেপির। কিন্তু এবার মোদিঝড়ে যেন খানিকটা হলেও ভাটার টান চিনিয়ে দিচ্ছে ভোটদানের হার কমে যাওয়া। এই পরিস্থিতিতে বিভাজন ইস্যু টেনেই চারশো-পার আসনের ভোট পাওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি।