নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরের আবহে বারে বারেই প্রশ্ন উঠছিল ভারতে সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে। যার উত্তরে গণতন্ত্রেরই জয়গান গেয়েছেন মোদি। কিন্তু সেই সময়েই এবং তার পরেও মোদি সরকারের মন্ত্রী এবং তাঁর দলের নেতারা যা বলছেন, সেইসব কথা মোদির বক্তব্যের উলটো পথে হাঁটছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশ্বের সামনে মোদি যে গণতান্ত্রিক দেশের ছবি সম্প্রতি তুলে ধরেছেন, এইসব চাপানউতোর কি সেই ছবিটিকেই সংকটে ফেলছে না বারবার? শুনে নিন।
গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিশেষভাবে সাড়া ফেলেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক মার্কিন সফর। প্রথমবার কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশনে দুবার বক্তব্য রেখেছেন। অংশ নিয়েছেন সাংবাদিক সম্মেলনেও। আর এই গোটা সফরেই বারবার মোদির উদ্দেশে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর আমলে ভারতে মানবাধিকারের গুরুত্ব ঠিক কতখানি। আর তার উত্তরে বারবার গণতন্ত্রের পক্ষেই জোর সওয়াল করেছেন মোদি। কিন্তু সেই সময়েই তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী কিংবা তাঁর দলের অনেক নেতার মুখেই এমন কথা শোনা গিয়েছে, যা রীতিমতো সাম্প্রদায়িক। আর এইখানেই প্রশ্ন ওয়াকিবহাল মহলের। তবে কি গণতন্ত্র নিয়ে মোদি যা বলছেন, তা কেবল কথার কথা হয়েই থেকে যাচ্ছে তাঁর নিজের দলের অন্দরেই?
আরও শুনুন: ভারতেও আছে ‘হুসেন ওবামা’! হিমন্ত বিশ্বশর্মার মন্তব্যে ক্ষিপ্ত বিরোধীরা, পালটা তোপ কংগ্রেসের
মোদির মার্কিন সফরের আগেই আমেরিকান কংগ্রেসের ৭৫ জন সদস্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি দিয়ে দাবি করেছিলেন, ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উত্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হোক মোদিকে। এরপরে সাংবাদিক সম্মেলনে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি তাঁকে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসেন, “আপনার দেশে মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত করতে এবং বাকস্বাধীনতা বজায় রাখতে আপনি ও আপনার সরকার কী পদক্ষেপ করছেন?” তার জবাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে গণতন্ত্রের জয়গান গেয়েছেন মোদি, বলেছেন, ভারতের এগিয়ে চলার মন্ত্র হল ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস, সব কা প্রয়াস’। সত্যি বলতে, ভারতের সংবিধান যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের কথা বলে, সেই সুরেই কথা বলেছেন মোদিও। ভারতের বৈচিত্র্যকে সম্মান দিয়ে সেই বৈচিত্র্য রক্ষা করার কথাও বলেছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে এ দেশকে সম্মানের জায়গা দিয়েছে।
কিন্তু যে সময়ে মোদি এ কথা বলছেন, সেই সময়েই তাঁর দলের একাধিক হেভিওয়েট নেতা মন্ত্রী কী বলছেন? মোদিকে সংখ্যালঘু নিয়ে প্রশ্ন করার জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো আক্রমণের সামনে পড়তে হয়েছিল সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকিকে। তিনি নিজে ধর্মপরিচয়ে মুসলিম। জানা গিয়েছে, তাঁর বাবা জন্মসূত্রে এ দেশের মানুষ হলেও পরে তাঁর পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। সেই পরিচয় টেনেই এই মার্কিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিলেন হিন্দুত্ববাদীরা। তাঁর এই প্রশ্নকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, এবং তাঁকে ‘টুলকিট গ্যাং’-এর একজন বলে বিঁধতে ছাড়েননি বিজেপি নেতা তথা দলের আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য। শুধু সাবরিনাই নন, সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা করে একই আক্রমণের মুখে পড়েন খোদ বারাক ওবামা-ও। তাঁকে পালটা দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। ওবামার পাশাপাশি মুসলিমদেরও বিঁধে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা কটাক্ষ করেন, ভারতেও অনেক হুসেন ওবামা রয়েছে। বলাই বাহুল্য, মোদি যে গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন, অন্য মতকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছিলেন, সে কথার উলটো দিকেই দাঁড়িয়ে এইসব মন্তব্য। এমনকি সিদ্দিকির বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণের নিন্দা করে বিবৃতি দেয় হোয়াইট হাউসও। তারা এ কথাও বলতে ছাড়েনি, মোদির সফরের সময় ভারতের গণতন্ত্রের যে নীতিগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, এই আচরণ তার পরিপন্থী।
আরও শুনুন: মোদিকে সংখ্যালঘু-প্রশ্ন করে বিদ্রুপের শিকার, ভারতের জার্সি গায়ে ‘জবাব’ সেই মুসলিম সাংবাদিকের
এমনিতেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা বারেবারেই অভিযোগ তোলেন, দেশের সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। সম্প্রতি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়েও দেশের মুসলিম গোষ্ঠীগুলির পক্ষ থেকে বিরোধিতার সুর উঠেছে। এর মধ্যেই একাধিক বিজেপি নেতার মন্তব্যে ইশারা মিলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষেরই। সারা বিশ্বের সামনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের যে গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিটি তুলে ধরেছেন, সেই ছবিটিকেই সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এ জাতীয় মন্তব্য, এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের।