র্যাগিং-এর জেরে একটি প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়া মর্মান্তিক। তা নিয়ে শোকও সংগত, সংগত প্রশ্ন করাও। কিন্তু ঠিক ঠিক প্রশ্ন করছি তো? প্রতিকার চাওয়াকে যদি ছাপিয়ে ওঠে প্রতিশোধের দাবি, তাহলে কি সেখানে নির্যাতকের সুরই জেগে উঠবে না? শুনে নেওয়া যাক।
মণিপুর এখন কেমন আছে? আপনাদের মনে আছে! এই কদিন আগেই সেখানকার ঘটনা নিয়ে আমরা সকলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। আপাতত তা দূরে সরে গেছে। কেননা এই মুহূর্তে আমরা সকলেই যাদবপুরের ঘটনায় শোকাহত।
তা শোকাহত হওয়াই সঙ্গত বটে। নাবালক পড়ুয়ার এমন মর্মান্তিক মৃত্যু তো কাম্য হতে পারে না। কলকাতা পুলিশকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এই কারণে যে, তাঁরা অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করেছেন। হয়তো আরও কাউকে কাউকে পাওয়া যাবে। যারা অপরাধী, দোষী তাদের সাজা দিতে পারে দেশের আইনকানুনই। অতএব পুলিশের কাজ পুলিশ করছে।
আরও শুনুন: ধর্ষণের ঘটনাতে সায় মহিলাদেরও! অরুন্ধতী বলছেন, আমাদের এখন ‘গভীর অসুখ’
তবে শুধু এই ঘটনায় দোষী খোঁজার ভিতরই প্রশ্নটা আর আটকে নেই। বঙ্গের এক বড় অংশ গোটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কেই এ প্রসঙ্গে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এবং, মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তা নিয়ে বিস্তর চর্চা। একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেলে ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আলোচনা চলবেই, তা দোষেরও নয়। অনেক সময়, পড়ুয়ারাও যা বলে ফেলছেন, তা-ও সমর্থনযোগ্য নয়। তবে, এই চাপানউতোরের ভিতর সত্যিই কি আসল প্রশ্নগুলোকে আমরা ছুঁতে পারছি! যেমন, প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি নেই কেন? এক অংশের দাবি তা আছে। এর পালটা মতও আছে। কিন্তু ধরা যাক, নিয়মকানুন মেনে সিসিটিভি ইন্সটল করাই হল। তা কি র্যাগিং-এর মতো সামাজিক অসুখের প্রতিবিধান হয়ে উঠতে পারে! দেশের অন্যান্য নামী যে প্রতিষ্ঠানে সিসিটিভি পর্যাপ্ত সংখ্যায় আছে, সেখানেও কি একইরকম ঘটনা ঘটছে না! প্রশ্নটা কি তাহলে শুধু সিসিটিভি বসানোর, নাকি অন্য কিছু! আসল প্রসঙ্গটি বোধহয় ভিন্নই। তা হল, প্রযুক্তির ব্যবহার অপরাধ প্রবণতাকে বন্ধ করতে পারে না। পারলে আগের থেকে দেশে অপরাধ অনেক কমত। প্রযুক্তি অপরাধী ধরতে সাহায্য করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ধরেই নেয় যে, সেখানে অপরাধীর অবাধ বিচরণ, তাহলে সে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল কোথায়! নিয়ম মেনে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতই থাক, তাতে অপরাধ ঘটে গেলে প্রাথমিক প্রমাণ অন্তত মিলবে; তবে তার থেকেও বেশি জরুরি হল তরুণ-মন থেকে দুর্বলকে অত্যাচারের এই প্রবণতা মুছে দেওয়া। তা কি প্রযুক্তি আদৌ করে উঠতে পারে!
আরও শুনুন: শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিং রুখতে সুপারিশ মিলেছিল আগেই, কী নির্দেশিকা ছিল সুপ্রিম কমিটির?
কিন্তু কথা হল, কিন্তু তরুণদের মধ্যে এত অপরাধ কেন? আজ অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ করে বলছেন, যাদবপুর যেন অন্য একটা দেশ, ভিন গ্রহ। তবে এ কথাও তো ঠিক যে, আমাদের বাড়ি কিংবা পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই সেখানে পড়তে গিয়েছে। রাতারাতি তো তারা ভিনগ্রহী হয়ে উঠতে পারে না। তাহলে কি ভূত সর্ষের ভিতরেই? অর্থাৎ, যে পরিবেশ তাদের দেওয়া হয়েছে, তাই কি এতখানি অপরাধপ্রবণ, যে সেই অন্ধকারে ছেয়ে আছে তরুণদের মন ও মনন! সামাজিক সেই অপরাধ দূর করতে আমরা কি আদৌ সচেষ্ট হয়েছি? পাশাপাশি আমাদের পাঠ্যক্রমের ভিতর থেকেও কি ক্রমশ সেই উপাদানগুলি অদৃশ্য হচ্ছে, যা আমাদের আরও একটু সংবেদনশীল হতে শেখায়? যাদবপুরকে একঘরে করার আগে নিশ্চিতই এ প্রসঙ্গ ভাবা জরুরি।
তবে, এই যে শোককে শিখণ্ডী করে রাজ্য তথা দেশের একটি নামী প্রতিষ্ঠানকে আমরা ক্রমশ একঘরে করছি, তাতে কি আখেরে কোনও লাভ হবে! নাকি এই প্রবণতা আসলে সেই রাস্তাই দেখিয়ে দেয়, যার অন্তে দাঁড়িয়ে অমর্ত্য সেনকেও কটূক্তি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য! জেনেশুনে আমরা সেই অবনমনকেই কি অনুমোদন দিচ্ছি না! কেননা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করলেই তো দেশ থেকে র্যাগিং নির্মূল হবে না। দেশের বহু প্রতিষ্ঠান এই অসুখের শিকার। তার সামাজিক প্রতিবিধান নিয়ে আমরা কখনও ভেবেছি বা প্রশ্ন করেছি? আজ যে নানা প্রশ্ন করছি, তা হয়তো অসঙ্গত নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, আসল প্রশ্নগুলো কি আমরা আদৌ করছি? নাকি যখন চারিদিকে রাষ্ট্রের ফাঁস আমাদের আত্মায় চেপে বসছে, বিভিন্ন ভাবে চলছে নজরদারি, তখন একটি ‘সফট টার্গেট’কেই আমরা নানা প্রশ্নে উত্যক্ত করে চলেছি!
মৃত্যু মর্মান্তিক, তার প্রতিকার জরুরি। কিন্তু তাকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠানকে হাস্যাস্পদ করে তোলা বোধহয় কাম্য নয়। বরং যে পরিবেশ এবং পরিস্থিতি এই নিদারুণ ঘটনার জন্ম দিল, তা বদলে দেওয়ার কাজ করতে হবে আমাদেরই। তবে একটা ঠিকঠাক প্রতিকারের জন্য ঠিকঠাক প্রশ্ন করা জরুরি। অভিযোগের গুঁতোয় সে প্রশ্নগুলো করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি না তো!
অতএব অন্তিম প্রশ্ন, আজ সকলেরই শোকাহত মনে নানা প্রশ্নের ঘটা। কিন্তু কাল অন্য ইস্যু এলে র্যাগিং-এর মতো সামাজিক অসুখের প্রসঙ্গটিকে ভুলে যাবেন না তো! গোড়ায় যে কথাটা উঠেছিল, সেই জায়গাতেই তাই ফিরে আসা যাক। মণিপুরে এখন কী হচ্ছে, খোঁজ রেখেছেন? মণিপুর নিয়েও আমরা কিন্তু দুঃখিতই হয়েছিলাম।