যুদ্ধের খবর করা তাঁর কাজ। কিন্তু সেই যুদ্ধে খবর হয়ে গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তান সহ গোটা পরিবার। তারপরেও, পরের দিনই ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছেন এই সাংবাদিক। ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের যুদ্ধের মাঝখানে, প্রতিবাদের নিশান বওয়ার অধিকার হয়তো তাঁরই।
গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে এই মানুষটির শোক। যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে হাজার হাজার মানুষের লাশ দিয়ে। যে মানুষেরা সে দেশ ভাগ করেনি। দুই দেশের মধ্যে খড়ির দাগ টানতে যায়নি তারা। তারা যুদ্ধের ময়দানেও যায়নি। তবুও, দিনের শেষে যুদ্ধের বলি হওয়া ছিল তাদেরই নিয়তি। ঠিক যে নিয়তির শিকার হয়েছে এই পরিবারটি। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, নাতি- এক মুহূর্তে নিজের গোটা পরিবারকে মুছে যেতে দেখেছেন ওয়ায়েল আল-দাহদৌয়ে। পেশায় সাংবাদিক তিনি। আল জাজিরার গাজা ব্যুরোর প্রধান। যে সময় বিমানহানা চলছিল, সেই সময় গাজার নুসেরত ক্যাম্প এলাকায় বাড়িতেই ছিলেন দাহদৌয়ের পরিবারের সদস্যরা। বিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। একইসঙ্গে মৃত্যু হয় দাহদৌয়ের স্ত্রী-সন্তানদের। যুদ্ধ আর যুদ্ধের দৌলতে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু, এ ঘটনা তো তাঁর কাছে নতুন নয়। তবে এতদিন যা নিয়ে খবর করতেন তিনি, এবার সেই খবর ঢুকে এসেছে তাঁরই অন্দরমহলে। না, তাতেও কিন্তু হাল ছাড়েননি এই সাংবাদিক। স্ত্রী সন্তানকে হারিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি। চোখে জল নিয়েই ফের ময়দানে ফিরে এসেছেন ওয়ায়েল আল-দাহদৌয়ে। ‘প্রেস’ লেখা পোশাক, হেলমেট পরে, হাতে বুম নিয়ে সেই হামলার পরবর্তী দৃশ্য গোটা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজে লেগে পড়েছেন তিনি। তিনি জানেন, তিনি একা নন। এই মুহূর্তে একই শোক কুরে কুরে খাচ্ছে সেখানকার আরও অনেককেই। আর সেই যন্ত্রণাকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা তাঁর পেশাগত দায়িত্ব তো বটেই, হয়তো মানবিক তাগিদও।
আরও শুনুন: নারীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই, মেহবুবা-মহম্মদির নোবেল স্বীকৃতিই যেন সত্যিকার দেবীপক্ষ
হামাস বনাম ইজরায়েলের যুদ্ধে নিহতের আসল সংখ্যা কত, সে হিসেব মুলতুবি রাখলেও, জনরব বলছে, সংখ্যাটা সাত হাজারের বেশি বই কম নয়। ইতিমধ্যেই নিহত শিশুর হিসাব ছাড়িয়েছে দুহাজার। যদিও তারপরেও যুদ্ধবিরতির কোনও লক্ষণ নেই। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জাপানের মতো বড় বড় শক্তির বিরোধিতায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে হেরে গিয়েছে শান্তিপ্রস্তাব। এমনকি গোটা পৃথিবীও এত মৃত্যু আর এত রক্ত নিয়ে তেমন সরব হল কই! হয়তো ধর্ম, হয়তো বর্ণ, হয়তো রাজনীতি- কিংবা হয়তো একযোগে সব বিষয় দিয়েই এই মুহূর্তে নির্ধারিত হচ্ছে প্রতিবাদ। তাই এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বারবার, বাইরের পৃথিবীর কাছে এই মানুষদের কথা পৌঁছে দেওয়াই জরুরি বলে মনে করছেন এই সাংবাদিক। যে তাগিদের কাছে হয়তো নগণ্য হয়ে গিয়েছে তাঁর তীব্র শোকও।
আরও শুনুন: নিহত সেনাদের চিঠি থেকে শরণার্থী শিবিরের চিহ্ন, যুদ্ধের স্মৃতি জমাচ্ছে ইউক্রেনের মিউজিয়াম
প্রাচীনকালে বলা হত, দূত নাকি অবধ্য। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সে কথা খাটে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে, বিরোধের পটভূমিতে সাংবাদিকরাও যে নিরাপদ নন, সে কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আজকের পৃথিবী। তালিবানের আফগানিস্তান দখলের সময় নিহত হয়েছিলেন চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের ময়দানেও ফের বিপন্ন হচ্ছেন একের পর এক সাংবাদিক। তারপরেও, মরণপণ করে সেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন ওয়ায়েল আল-দাহদৌয়ের মতো সাংবাদিকরা। যাঁরা জানেন, যুদ্ধের পৃথিবীতে মানুষের সত্যকে প্রকাশ করে চলা তাঁদেরই দায়। এই সত্যের পথে চলাই তাঁদের যুদ্ধ। এই সাংবাদিকেরা জানেন, সব যুদ্ধ জেতার জন্য লড়া হয় না। তবু কেউ কেউ যে ময়দানে থেকে গিয়েছিল, ইতিহাসকে এ কথা বলে যেতে হয়। আর সেই সত্যান্বেষণই করে চলেছেন ওয়ায়েল আল-দাহদৌয়েরা।