স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা থাকে ভোটরঙ্গ। ভোটের পর সংসদে শপথ অনুষ্ঠানেও রাজনীতির ভাষ্য চেনাল সেই স্লোগানেরাই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রাজনীতির দুনিয়ায় স্লোগান এক অদ্ভুত হাতিয়ার। আদতে গোটা দেশের রাজনীতির বয়ান ধরা পড়তে থাকে স্লোগানের মিছিলে। সে রাজনৈতিক ইতিহাসের চলন কীভাবে বদলে বদলে যাচ্ছে, তার মানচিত্র লিখতে পারে স্লোগান। ভোটের প্রচারে সভা-মিছিলে যেমন স্লোগানে স্লোগানে তরজা জমে ওঠে, তেমনই ভোটের পরেও স্লোগান চর্চা থামে না। যার রেশ এবার ধরা পড়ল সংসদ ভবনে নবনির্বাচিত সাংসদদের শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানেও। আর সেখান থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠল দেশের এই সময়ের রাজনীতির চালচলনও।
আরও শুনুন:
অঙ্কে থাকে ভোটব্যাঙ্কের হিসাব, তবু কমল মহিলা ও সংখ্যালঘু সাংসদের সংখ্যা
লোকসভা ভোটে জিতে তৃতীয়বারের জন্য মসনদ দখল করেছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বেই ফের তৈরি হয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার আসনসংখ্যার নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে বিজেপি শিবির। জোটসঙ্গীদের উপর ভরসা করেই সরকার গড়তে হয়েছে তাদের। এদিকে লোকসভায় রীতিমতো ভালো ফল করে বিরোধিতার জমি শক্ত করে ফেলেছে ইন্ডিয়া জোট। সংসদের রাজনৈতিক লড়াইয়ে এবার যে ফাঁকা মাঠ আর পাবে না বিজেপি, সাংসদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল। আর তা অনেকখানিই স্পষ্ট করে দিল নানা ধরনের স্লোগানেরা। বর্ষীয়ান সাংসদদের মতে, এত বিচিত্র বিষয়ে স্লোগান অতীতে অন্তত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শোনা যায়নি।
কীরকম স্লোগানে মুখর হল সংসদ ভবন?
জানা যাচ্ছে, হিন্দু রাষ্ট্র থেকে প্যালেস্টাইনের নামে জয়ধ্বনি শোনা গিয়েছে। কার্যত দুই বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক মত ধরা পড়েছে স্লোগানে। একইভাবে রাম থেকে ভীমের নামেও উঠেছে জয়ধ্বনি, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের উচ্চম্মন্য রাজনীতির পাশেই দাঁড়িয়ে দলিত রাজনীতির আদর্শও। শোনা গিয়েছে, বরেলির বিজেপি সাংসদ ছত্রপাল গঙ্গোয়ার শপথ শেষে ‘হিন্দু রাষ্ট্রের জয়’ বলে ধ্বনি তোলেন। আবার হায়দরাবাদের এআইএমআইএম নেতা আসাদ্দউদিন ওয়াইসি শপথের শেষে ‘জয় ভীম’, ‘জয় তেলেঙ্গানা’ বলার পরে ‘জয় প্যালেস্টাইন’ বলেও স্লোগান দেন। ইন্ডিয়া জোটের সাংসদদের ‘মণিপুর’ ‘মণিপুর’ স্লোগানের মধ্যে শপথ নেন বিধ্বস্ত রাজ্যটি থেকে জিতে আসা দুই কংগ্রেস সাংসদ। এঁদের মধ্যে আনগোমচা বিমল আকৈজাম সংবিধান হাতে নিয়ে মেইতেই ভাষায় শপথ নেন। অ্যালফ্রেড কাংগাম এস আর্থার ইংরেজিতে শপথবাক্য পাঠ করলেও হিন্দিতেই ন্যায়বিচারের দাবি তোলেন মণিপুরের জন্য। তবে এখানেই শেষ নয়। রাম মন্দিরের এলাকা থেকে জিতে আসা সাংসদ অবধেশ প্রসাদ শপথ নেওয়ার সময় ওঠে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। তবে বিজেপি নয়, বিরোধী বেঞ্চ থেকেই সে স্লোগান এসেছে। বিজেপি যে ধ্বনিকে একরকম আধিপত্যের হুংকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তার পালটা বিজেপির আধিপত্য রুখে দেওয়ার স্লোগানও হয়ে উঠল সেই একই ধ্বনি। এসবের পাশাপাশি নিট দুর্নীতি নিয়েও স্লোগান তুলেছেন পূর্ণিয়ার নির্দল সাংসদ পাপ্পু যাদব। সংসদ ভবনের বাইরে নিট ইস্যুতে প্রথম থেকেই মুখর হয়েছেন সাংসদরা, সংসদের ভেতরেও ছাপ ফেলল সেই প্রতিবাদ।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
এ দেশ তো আসলে বহুত্ববাদের কথাই বলে নানাভাবে। নানা মত, নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলে। সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বারবার সেই বহুমাত্রিকতাকে নস্যাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। ভিন্ন ধর্মই হোক কি ভিন্ন মত, সবকিছুর উপরেই নানাভাবে দমননীতি নেমে এসেছে। লোকসভায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া, এবং বিরোধীদের শক্তিবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে আসলে সেই দমননীতিই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। গণতন্ত্রে যে নানা মতের স্বর উঠে আসার কথা, সেই বিষয়টিও মান্যতা পেয়েছে এই সূত্রে। আর শপথগ্রহণের অনুষ্ঠানে নানা মত ও আদর্শের স্লোগান সেই বহুত্বকেই আরও একটু প্রতিষ্ঠা করে দিল।