ধর্ষণকাণ্ডের পর বিচারের দাবি ওঠে। জনগণের ভোটে জিতে আসা প্রশাসনের কাছেই বিচার চায় জনতা। অথচ সেই ভোটের টিকিট পাওয়ার ভিড়ে তো এমন নামও থাকে, যে নিজেই ধর্ষণ বা নিগ্রহে অভিযুক্ত। ধর্ষণে অভিযুক্তরা যদি ভোটে দাঁড়ান, বিচারের দাবি তবে কোথায় পৌঁছবে?
ধর্ষণের ঘটনার পর বিচারের দাবি ওঠে। ওঠে নারীদের সুরক্ষার দাবিও। আরেকদিকে ধর্ষণ আদৌ হয়েছে না হয়নি, এর মধ্যে ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক তরজা। সমস্ত বিষয়টার একদিকে দাঁড়িয়ে থাকে জনতা, আরেকদিকে জনতার ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা প্রশাসন। কিছু মানুষের ভোট পাওয়া বিরোধীরাও থাকেন বইকি এই পুরো পরিস্থিতির মধ্যে। মহিলাদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নানা প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বিচারের দাবিতে এই সমস্ত বিক্ষোভ, আশ্বাস, সবকিছুর মধ্যেও যে প্রশ্ন উঠে আসে, তা হল- কয়েক গুচ্ছ সরকারি শপথ এবং আয়োজনের পরও কেন আমাদের দেশ মেয়েদের ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না? আর সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই মনে পড়ে যায়, ভোটে লড়ার জন্য প্রত্যেকটি দল যে প্রার্থীদের টিকিট দেয়, তাদের মধ্যে অনিবার্যভাবে এমন কিছু নাম থাকে, যাদের সঙ্গে ধর্ষণ বা নির্যাতনের অভিযোগ জড়িয়ে আছে। যে জননেতা ভোটে জিতে প্রশাসক হবেন, যাঁর উপরে নারীদের নিরাপত্তা বজায় রাখার দায়ও বর্তাবে, তিনিই যদি নির্যাতনে অভিযুক্ত হন,- তাহলে রক্ষকের ভক্ষক হয়ে ওঠার প্রবাদই কি প্রকারান্তরে সত্যি হয়ে যায় না?
আরও শুনুন:
‘রিস্ক নিয়েছিলাম, তো?’ ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের ভূত তাড়িয়েছিলেন নির্যাতিতা নিজেই
প্রতি ষোলো মিনিটে এ দেশের একজন নারী ধর্ষিত হন। অনেকে খুনও হয়ে যান। এ অবস্থায় দেশের শাসকদের, দেশের প্রতি রাজ্যের শাসকদের নারীর নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা ছিল। আর তার জন্যই প্রশাসকের ভূমিকায় বেছে নেওয়ার কথা ছিল এমন মানুষদের, যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে সহমর্মী। অথচ এবারের নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ দ্বিতীয়বারের মোদি জমানায় সংসদে দেখা গিয়েছিল, লোকসভায় ৫৪৩ জন সদস্যের মধ্যে ২৩৩ জনের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক কাজের লিখিত অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণ কিংবা নারীনির্যাতনের একাধিক ঘটনা। কংগ্রেস, জেডিইউ, ডিএমকে, টিএমসি ইত্যাদি প্রায় সব দলই এই ধরনের অভিযুক্তদের টিকিট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। শাসক দল বিজেপির মোট ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে এই অভিযোগ ছিল ১১৬ জনের বিরুদ্ধেই। মনে করে নেওয়া যাক, কাঠুয়া কাণ্ডের সময় ধর্ষকের সমর্থনে আইনপ্রণয়নকারী নিজেই মিছিলে যোগ দেন। উন্নাও কাণ্ডে অভিযুক্ত কুলদীপ সেঙ্গারকে ফের টিকিট দেওয়ার কথা উঠেছিল। যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদে কুস্তিগিরদের তুমুল আন্দোলনের পরেও ব্রিজভূষণ শরণ সিং-কে বিজেপি সাংসদের পদ থেকে সরানো হয়নি। চব্বিশের নির্বাচনে তাঁকে টিকিট না দিলেও তাঁর ছেলেকেই ওই কেন্দ্র থেকে দাঁড় করানো হয়, এবং নির্বাচনী প্রচারেও সগৌরবে হাজির থাকেন ব্রিজভূষণ।
২০২৪-এর নির্বাচন অবশ্য ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ তিনবারের নির্বাচনকেই একটি হিসেবে ছাপিয়ে গিয়েছে। নানা অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই পনেরো বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় টিকিট পেয়েছেন এই নির্বাচনে। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস-এর সমীক্ষায় দেখা যায়, মোট প্রার্থীদের মধ্যে ২০ শতাংশ ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত, অর্থাৎ মোট ৮৩৩৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৬৪৩ জন। আর ১৪ শতাংশ খুন, ধর্ষণ, অপহরণের মতো গুরুতর মামলায় জড়িয়ে, অর্থাৎ ১১৯১ জন। সমীক্ষাটি আরও জানিয়েছিল, অন্তত ১৯৭ জন প্রার্থী নারীঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত। এ তো গেল সরাসরি অপরাধের কথা। তা ছাড়া নারীর প্রতি অবমাননাসূচক মন্তব্যের ক্ষেত্রে তো কোনও দলই কম যায় না। সে বিরোধী দলের মহিলা প্রার্থীকে যৌনগন্ধী মন্তব্য করাই হোক, কিংবা ধর্ষণ-নিগ্রহের ঘটনার পর মহিলার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলাই হোক। কাঠুয়া কাণ্ডের সময় যেমন গেরুয়া পতাকার মিছিল হয়, তেমনই উন্নাও-হাথরাসের সময় বিজেপির দিকে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর সমাজবাদী দলের নেতা আবু আজম বলেছিলেন, “ধর্ষিত হয়ে বেঁচে যাওয়া মেয়েদের ফাঁসি হওয়া উচিত।” আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত আবার মেয়েদের অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে বাইরে বেরোনোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। বাংলাতেও কখনও বানতলা, কখনও পার্ক স্ট্রিট, ধর্ষণকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন নেতানেত্রীরা।
আরও শুনুন: বাড়ছে ধর্ষণের হার, তুলনায় শাস্তি হচ্ছে কি! আর জি কর যে প্রশ্ন তুলল ফের
অন্যায় যে করে, সে যেমন অপরাধী, অন্যায় যে সহে তার অপরাধও কিন্তু কম নয়। এ সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা তাদের ‘এনেবলার’ বলে চিনি। আর এও জানি, নির্বাচনী প্রচারে, বিধানসভায়, সংসদে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীর প্রতি যে মানসিকতা প্রকাশ পায়, তা নারীনিগ্রহকে আরও একটু শক্ত জমিতে দাঁড় করায়। সেই বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ্য প্রকাশটুকুও যদি বন্ধ না করা হয়, ধর্ষিতার জন্য ন্যায়বিচার চাওয়া তবে সাময়িক হয়েই থাকে। রাজনীতিতে মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন যাঁরা, মহিলা নাগরিকের স্বাধীনতা, স্বাধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার বিষয়টিকে তাঁরাই যদি এমন চোখে দেখেন, তাহলে বিচারের দাবি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছবে আর?