প্রিয় বেগম মমতাজের সমাধিসৌধ গড়ার জন্য যে স্থান নির্বাচন করেছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান, আদতে সেই জমিটিই নাকি তাঁর মালিকানাধীন ছিল না। এক হিন্দু রাজার জমিতেই সেদিন গড়ে তোলা হয়েছিল তাজমহল। এই দাবির জের টেনে বারবার ঘনিয়েছে বিতর্ক। এমনকি তাতে জুড়েছে ওয়াকফ বোর্ডের নামও। ঠিক কী দাবি ছিল তাদের? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। প্রতি বছর সামনে থেকে তাজমহল দেখার জন্য বিদেশ থেকে উড়ে আসেন পর্যটকরা। তাঁদের চর্চার একমাত্র বিষয় এর সৌন্দর্য। কিন্তু দেশের অন্দরে তাজমহল নিয়ে চর্চার আরও অনেক বিষয় রয়েছে। সাম্প্রদায়িক ইস্যু যার অন্যতম। হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ এই দাবি করেন যে, এই তাজমহল একসময় শিবমন্দির ছিল। পালটা ওয়াকফ বোর্ডের তরফেও তাজমহলের জমির মালিকানা দাবি করা হয়। সম্প্রতি দেশজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে যে চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে তাজমহলের প্রসঙ্গও সামনে এসেছে।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯৮ সালে। ফিরোজাবাদের এক মুসলিম ব্যবসায়ী দাবি তুললেন, তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হোক। উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের কাছে এই মর্মে একটি চিঠিও পাঠান তিনি। সেখানে দাবি করেন, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরত্বের বিচারে তাজমহলের জলি অবিলম্বে ওয়াকফ মালিকানার অধীন ঘোষণা করা হোক। সেক্ষেত্রে সৌধের যাবতীয় দেখভালের দায় নেবেন তিনি। ততদিনে এই সৌধের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে এএসআই অর্থাৎ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হাতে। তাই তাদের দপ্তরে ওয়াকফ বোর্ডের তরফে নোটিশ পাঠানো হয়। বিষয়টা অল্পদিনেই আদালত অবধি গড়ায়। মামলা হয় এলাহাবাদ হাই কোর্টে। ফিরোজাবাদের সেই ব্যবসায়ী আদালতে নিজের পুরনো দাবি জানিয়ে মামলাটি করেছিলেন। তাতে সঙ্গ ছিল ওয়াকফ বোর্ডের। যেহেতু তাজমহলের মতো সৌধকে নিয়ে এমন বিতর্ক, তাই হাইকোর্টের তরফে বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা বলা হয়। তাও ওয়াকফ বোর্ড নিজেদের দাবিতে একপ্রকার অনড় ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্ত হয় এএসআই। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে বলবে সেটাই মেনে নিতে হবে, এই মর্মে ওয়াকফ বোর্ডের তরফেও সবরকম চেষ্টা চালানো হয় তাজমহলকে নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করার। তবে সুপ্রিম বিচারপতি সাফ জানিয়ে দেন প্রমাণ করার কথা। অর্থাৎ ওয়াকফ যদি তাজমহলকে নিজেদের সম্পত্তি বলতে চায়, তাহলে যথাযোগ্য প্রমাণ দিতে হবে, এমনটাই নির্দেশ দেন তিনি। খোদ সম্রাট শাহজাহান এমন কিছু ঘোষণা করেছিলেন কি না, সেটাই প্রমাণ করতে বলা হয়।
দীর্ঘদিন এই মামলা চলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগ তৈরি হয়। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিষয়টার তীব্র প্রতিবাদে সরবও হয়েছিল। ২০১৮ সাল অবধি বিভিন্ন সময় মামলার শুনানি হলেও কিনারা কিছুই হয়নি। বারে বারে উপযুক্ত প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে ওয়াকফ বোর্ড, আর মামলা পিছিয়েছে। শেষমেশ ওয়াকফ বোর্ডের তরফে দাবি করা হয়, যেহেতু তাজমহলে দুজন প্রখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্বের সমাধি রয়েছে, তাই এই সম্পত্তি ওয়াকফ মালিকানাধীন ঘোষণা করা হোক। তবে এই প্রমাণ যে একেবারেই উপযুক্ত নয় তা বলাই বাহুল্য। তাই সুপ্রিম কোর্টও তাতে মান্যতা দেয়নি। এত কিছুর পরও তাজমহলকে নিজেদের সম্পত্তি বলেই দাবি জানাত ওয়াকফ বোর্ডের একাংশ। তবে মুখের কথাই সার, সুপ্রিম কোর্টে কিছু প্রমাণ করতে না পারায় বিষয়টার আইনি ফয়সালা হয়নি। এখনও তাজমহল এএসআই এর তত্ত্বাবধানেই রয়েছে। আগামীতে তার বদলে হলে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই হতে পারে।