এক বা একাধিক ডিগ্রি থাকলেই কর্মচারী তথা মানুষ হিসেবে দর অনেকখানি বেড়ে যায়, বিগত বহু বছর ধরে এমনটাই মোটামুটি ধারণা ছিল গড় শিক্ষিত মানুষের। তবে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনা এই বুনিয়াদি ভাবনার গোড়ায় ধাক্কা দিয়েছে। সমীক্ষা বলছে, ডিগ্রির থেকেও স্কিলের গুরুত্বই বর্তমানে বেশি। এহেন অসম লড়াইয়ে জয়ী হবেন কে?
যোগ্য এবং অযোগ্য। দুটি শব্দ এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। উঠে আসছে সংবাদের শিরোনামে। সে প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র, অতএব থাক। তবে, এ কথা বোধহয় বলাই যায় যে, প্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলে যোগ্য এবং অযোগ্যের ধারণাও বদলে বদলে যায়। একজন যে বিষয়ে যোগ্য, অন্যজন সে বিষয়ে তেমন পারঙ্গম নাই-ই হতে পারেন; তা বলে তো আর তাঁকে অযোগ্য বলা যায় না! কথা হচ্ছে, যোগ্যতার বিচার কোন ক্ষেত্রে কীভাবে হচ্ছে, তার উপরই সমস্তটা নির্ভর করছে। ফিলহাল চাকরি বাজারেও তাই যোগ্য-অযোগ্যের ধারণায় নানা রদবদল।
ব্যাপারটা আর একটু তলিয়ে ভাবা যাক। হয়তো আপনি বহু বছর ধরে বহু শ্রম ব্যয় করে থিসিস লিখে শেষ করেছেন; আপনার নামের সঙ্গে জুড়ে আছে রাশভারী ডিগ্রি; অথচ চাকরি খুঁজতে গিয়ে শুনতে হল, “ডিগ্রি নয়, কাজ কী কী পারেন, সেটুকু জানতে চাই!” আপনি নিঃসন্দেহে অবাক হবেন কারণ চাকরিক্ষেত্রে যোগ্যতর তকমা লাভ করতেই তো এতদিনের পড়াশুনো! কিন্তু নিয়োগকর্তার ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে, তিনি কেবল জানতে চান, হাতে-কলমে ঠিক কোন কাজগুলিতে আপনি সড়গড়। বর্তমানে একটি কেরিয়ার-বেসড্ অ্যাপের সমীক্ষায় সামনে এসেছে এমনই বাস্তব-ছবি। কেবল ভারত নয়, সিঙ্গাপুর, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার কর্মসন্ধানীরাও একবাক্যে সহমত হয়েছেন এতে।
এক বা একাধিক ডিগ্রি থাকলেই কর্মচারী তথা মানুষ হিসেবে দর অনেকখানি বেড়ে যায়, বিগত বহু বছর ধরে এমনটাই মোটামুটি ধারণা ছিল গড় শিক্ষিত মানুষের। এ জাতীয় ভাবনা আদতে ‘প্রেজুডিস্ট’ ও পক্ষপাতদুষ্ট হলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ যে কোনও ব্যক্তির নামের পাশে গর্বে জ্বলজ্বলে ডিগ্রিগুলিই বুঝিয়ে দেয়, সেই মানুষটি শিক্ষার জগতে কতখানি পথ অতিক্রম করেছেন। শিক্ষাই কোনও মানুষকে তার আশেপাশের জনেদের থেকে উচ্চ আসনে তুলে ধরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, গতানুগতিক চাকরিক্ষেত্রগুলিতেও অন্য প্রার্থীদের থেকে ডিগ্রিধারী পদপ্রার্থীদের গণ্য করা হয় অনেক বেশি সম্মানের সঙ্গে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনা এই বুনিয়াদি ভাবনার গোড়ায় ধাক্কা দিয়েছে। ফলত বদলেছে ভাবনাও। কেবল ডিগ্রি অর্জনে সফল ব্যক্তিই কি বর্তমান সময়ের দ্রুত পরিবর্তনশীল কর্মক্ষেত্রের পক্ষে উপযোগী? নাকি ময়দানে টিকে থাকবার জন্য আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন রয়েছে? সমীক্ষা বলছে, ডিগ্রির থেকেও স্কিলের গুরুত্বই বর্তমানে বেশি।
বিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেনসার প্রথমবার প্রস্তাব করেছিলেন ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ তত্ত্বটি, যা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন সমর্থন করেন ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মত অনুযায়ী, কেবলমাত্র সেই সকল জীবই অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয় যারা ক্রমাগত অভিযোজনে সক্ষম; যারা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। চাকরির বাজারে ডারউইন সাহবকে ছুঁয়ে বলা যায়, যাঁরা নিজেদের সময়মতো ‘আপডেট’ বা ‘আপস্কিল’ করতে পারবেন, তাঁরাই অভিযোজনের রাস্তায় এগিয়ে যাবেন।
বছরকয়েক আগে, অর্থাৎ ২০২০ সালে ফিরে গেলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। করোনার দাপটে আচমকাই বিশ্ব জুড়ে অচলাবস্থা। স্কুল-কলেজ বন্ধ। কস্ট-কাটিং-এর উদ্দেশ্যে সংস্থাগুলিতে নির্বিচারে চলছিল কর্মী ছাঁটাই। কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে সামগ্রিক বিপর্যয়। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-মডেল দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। এর পরে আসে হাইব্রিড মডেল। তা ছাড়া বহু সংস্থা এই মহামারীর সময়েই প্রথম পথচলা শুরু করে, যেগুলোর কাজের ধরন গতানুগতিক ধাঁচের থেকে একেবারে আলাদা। আর তখন থেকে নতুন এক প্রবণতা দেখা দেয়। এ জাতীয় সেট-আপ-এ কর্মীকে কেবল কাজের বিষয়ে দড় হলেই চলে না, প্রযুক্তিগতভাবেও সড়গড় হতে হয়। যাতে সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত করে রাখতে পারেন। আধুনিক সময়ের সমস্যাও জটিল, ফলে চটজলদি সেগুলো সমাধানের পথ ভেবে বের করতে হবে। উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকতে হবে, বাকপটু হলেও মন্দ হয় না। মনে রাখতে হবে, এ যুগ আদ্যোপান্ত গতিময়তার। যদি আমি পিছিয়ে পড়ি, অন্য কেউ এগিয়ে যাবে। আমার জন্য থেমে পিছন ফিরে দেখবে না কেউ।
তবে ডিগ্রির গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে? তা নয়। প্রাথমিকভাবে অবশ্যই ডিগ্রি দেখেই যে কোনও সংস্থা একজন চাকরিপ্রার্থীর প্রোফাইল বেছে নেবেন। কিন্তু কর্মচারী হিসেবে যোগদানের পর কেবলমাত্র দক্ষতাই তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত করতে পারে সংস্থার কাছে। অর্থাৎ বদলে যাওয়া দিনকালে, ডিগ্রিই যেন খানিক অযোগ্য হয়ে উঠেছে। বরং সময়ের সঙ্গে কে কতটা নিজেকে পরিণত করে তুলতে পারছেন, সেই স্কিলই হয়ে উঠছে যোগ্য। অথবা স্কিল-ই এখন নতুন ডিগ্রি। বদলের সময় যেন সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।