প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৯ বছরেরও বেশি সময় পার করেছেন নরেন্দ্র মোদি। জনপ্রিয়তার খাতিরে ইতিমধ্যেই দেশ বিদেশের একাধিক রাষ্ট্রনেতার থেকে এগিয়ে রয়েছে মোদি। অনেকেই তাঁকে একবাক্যে সেরার সেরা রাষ্ট্রনায়কের উপাধি দিয়ে থাকেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তাঁর দলের বিরুদ্ধে প্রায়শই মুসলিম বিদ্বেষের অভিযোগ উঠে থাকে। যার আঁচ লাগে মোদির গায়েও। কিন্তু বাস্তবে মুসলিমরাও কি মোদিকে একেবারেই অপছন্দ? ঠিক কী জানাচ্ছে সমীক্ষা? আসুন শুনে নিই।
‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়…’, দশ বছরের কেন্দ্রীয় শাসনে এই মন্তব্য প্রায়শই শোনা যায় বিজেপি নেতাদের মুখে। যে কোনও অসম্ভবকেই সম্ভব করতেন পারেন মোদি, এমনটাই দাবি তাঁদের। কিন্তু বিরোধীরা বরাবরই এই দাবি মানতে নারাজ। মূলত মুসলিম বিদ্বেষ ইস্যুকে সামনে রেখেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন তাঁরা। আঙুল ওঠে মোদির দিকেও। কিন্তু সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা জানাচ্ছে একেবারে অন্য তথ্য। মোদিম্যাজিকে মুগ্ধ হন মুসলিমরাও। এমনকী, হিন্দুদের থেকেও বেশি মোদির কথার জাদুতে মোহিত হন তাঁরা।
আরও শুনুন: ‘হিন্দু দেওয়ানি বিধি’ চালুর উদ্যোগ নিচ্ছেন মোদি! মুসলিমদের হয়ে পালটা সওয়াল ওয়েইসির
নরেন্দ্র মোদির প্রতি মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগ্রহ রয়ছে অনেকেরই। বিশেষত কোনও বিজেপি নেতা যদি মুসলিম বিরোধী মন্তব্য করেন, বিরোধীরা সেই ইস্যুতে একযোগে সরব হন। বর্তমানে ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে। এই আবহেই প্রকাশ্যে এসছে সিএসডিএস লোকনীতি-র বিশেষ সমীক্ষা। যার মূল বিষয় ছিল, মোদির জনপ্রিয়তা। এ প্রসঙ্গে হিন্দু মুসলিম প্রত্যেকের কাছেই প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিল এই সংস্থা। মোদি প্রসঙ্গে মূলত তিনটি প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে সমীক্ষাটি সাজানো হয়েছিল। সেইসঙ্গে আরও কিছু সাধারণ বিষয়ও যোগ করা হয়। সমীক্ষাটির মূল লক্ষ্য ছিল, মুসলিমরা মোদিকে নিয়ে ঠিক কী ভাবছেন তা আঁচ করা। মোদির কর্মদক্ষতা, প্রধানমন্ত্রীর আসনে তিনি কতটা সফল, এবং অবশ্যই তাঁর সরকারের মুসলিম বিদ্বেষ প্রসঙ্গে প্রশ্ন সাজানো হয়েছিল।
আরও শুনুন: বাকিদের মতো কেন ন্যায্য বিচার পাবেন না মুসলিম নারীরা? ‘এক দেশ এক আইনের’ পক্ষে সওয়াল মোদির
প্রথম প্রশ্নই ছিল মোদি সরকারের ভূমিকা নিয়ে। সেখানে অধিকাংশ মুসলিমের দাবি এই কবছরে এমন কোনও অবনতি হয়নি দেশের। অর্থাৎ দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি কিংবা বেকারত্বের মতো ইস্যু, যা নিয়ে বিরোধীরা প্রায়শই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন, তা নিয়ে বিশেষ তাপ-উত্তাপ দেখাননি মুসলিম সমাজের অনেকেই। দেখা যাচ্ছে ৪৪ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মনে করেন, অর্থনৈতিক অবস্থা মোটের উপর একই রকম আছে। এরপর বিজেপি সরকার নিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তাঁদের সামনে। সেখানেও মুসলিমদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েছে। কিন্তু এর পরের প্রশ্নটাই ছিল মোদির কোন গুণ সবথেকে বেশি পছন্দ করেন দেশবাসী। সেখানেই উঠে এসেছে অদ্ভুত তথ্য। দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের থেকেও বেশি শতাংশ মুসলিমরা মোদিকে সেরা বক্তা হিসেবে বেছেছেন। তাঁদের মতে মোদির মতো সুবক্তা সারা দেশে আর নেই। মোদির কথার জাদুতে যেমন মুগ্ধ ২৪ শতাংশ, তেমনই মুগ্ধ ২৯ শতাংশ মুসলিম। বলা বাহুল্য, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও মোদিকে সেরা বক্তার তকমা দিয়ে থাকেন। তাতেই যেন শিলমোহর দিয়েছে এই সমীক্ষা। বিশেষত মুসলিমদের মোদিকে সু-বক্তা হিসেবে বেছে নেওয়া, বেশ অবাক করেছে ওয়াকিবহাল মহলকে। শুধু বক্তা হিসেবে নয়, নতুন নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে মোদির ভূমিকা নিয়েও তারিফ করেছেন মুসলিমরা। এক্ষেত্রেও হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের তরফে বেশি ভোট পেয়েছেন মোদি। এই ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ হিন্দু মোদির পক্ষে, অন্যদিকে মুসলিমদের সমর্থন ১৪ শতাংশ। সেইসঙ্গে মোদির সামগ্রিক কর্মদক্ষতাও যে যথেষ্টই, সমীক্ষায় সেটিও স্পষ্ট করেছেন মুসলিমরা।
আরও শুনুন: মোদিকে সংখ্যালঘু-প্রশ্ন করে বিদ্রুপের শিকার, ভারতের জার্সি গায়ে ‘জবাব’ সেই মুসলিম সাংবাদিকের
এর থেকে মুসলিম সমাজের মোদির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিজেপি মানেই মুসলিম বিদ্বেষী, এরকমই একটি সাধারণ ধারণা অন্তত দশ বছর আগেও চালু ছিল। কিন্তু গত এক দশকে মুসলিম-মানসের এই একরৈখিক দিকটি আর নেই। বরং তা অনেকটাই জটিল জায়গা নিয়েছে। মোদি সরকারের সব কাজে যে মুসলিমদের সমর্থন আছে তা নয়। অর্থনীতির অবনমন, বেকারত্ব নিয়েও সমালোচনা করেছেন তাঁরা। বিকল্প হিসাবে হয়তো বিজেপির থেকে অন্য জাতীয় দলকেই তারা পছন্দ করেন বা আঞ্চলিক দলগুলিকে সমর্থন দেন। কিন্তু সেই বিকল্পই যে জাতীয় রাজনীতিতে নির্বিকল্প এমনটা তাঁরা একযোগে ভাবছেন না। এই ভাবনা থেকে মুসলিমদের একাংশের জনসমর্থন বিজেপির দিকেও যাচ্ছে। অর্থাৎ এই সমীক্ষা জানাচ্ছে ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’ বলে যে কথাটি রাজনীতিতে চালু, হয় তা একেবারেই নেই, অথবা তা আগের মতো নেই। বরং নানা প্রেক্ষিতের ভিত্তিতে মুসলিম ও মোদি সরকারের সম্পর্ক একটি মিশ্র জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। যেখানে পূর্ণ সমর্থনও নেই, আবার চূড়ান্ত বিদ্বেষও নেই। আর এই দিকটি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির কথার জাদু ও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। জনপ্রিয় নেতা হওয়ার যে গুণ, সেই গুনে মুসলিম জনমানসকেও যে অনেকটাই প্রভাবিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী, সমীক্ষার তথ্য স্পষ্ট সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।