আদালত মন্দির নয়, আর বিচারপতিকে ভগবান বলে মনে করলেই সর্বনাশ। সতর্ক করছেন খোদ শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি। ঠিক কী বললেন ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়? শুনে নেওয়া যাক।
আদালতকে ন্যায়বিচারের মন্দির বলে মনে করা আদৌ কাজের কথা নয়। আদালতের কাজ বিচার করা, সে বিচার ন্যায়ের পথেই চলবে এমনটা হওয়াই সংগত, কিন্তু তা বলে তার সঙ্গে মন্দিরের ধর্মীয় অনুষঙ্গ জুড়বে কেন? এ বিষয়েই এবার নিজের আপত্তি খোলাখুলি প্রকাশ করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। শুধু তাই নয়, আদালতকে মন্দির তকমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিচারপতিদের উপরেও যে প্রায় ঈশ্বরের তকমা লেগে যায়, সে বিষয়েও আদৌ খুশি নন তিনি। বরং এই প্রবণতাকে সর্বনেশে বলেই মনে করেন দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি।
আরও শুনুন:
বিরোধী বলে কি ভালো বলতে নেই! যোগীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ কংগ্রেসের মুসলিম সাংসদ
‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/ সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার’- বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ভাবনায়, বিচারকের জন্য কোনও পৃথক আসন বরাদ্দ ছিল না। যার বিচার হচ্ছে আর যিনি বিচার করছেন, এই দুজনকে আগে থেকেই উঁচু আর নিচু দুই অবস্থানে দাঁড় করানোও হয়নি। বরং মানবতার বিচারের দুজনেই সম অবস্থানে দাঁড়িয়ে, সেই ভাবনাতেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তো সে ভাবনার প্রয়োগ ঘটে না। বরং এক বা একাধিক আস্ত মানুষের বিচার করার ক্ষমতা বিচারককে সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেকটা বড় করে তোলে। সেই বড় হয়ে ওঠার পার্থক্য কাঠগড়ার এপার আর ওপার দুদিকের মানুষের মনেই জেগে থাকে। যে মানুষ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে কিংবা বিচারের আশায় অপেক্ষা করছে, তারা সেই ক্ষমতাকে দেখে অতিমানবিক ক্ষমতা হিসেবে। যেভাবে মানুষ বিশ্বাস করে ভগবান তার নিয়তির নির্ধারক, ঠিক একইভাবে একজন মানুষের হাতেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে দেখলে সেই মানুষকে সে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আসনেই বসিয়ে ফেলে। একে তো একটি গণতান্ত্রিক পরিসরে এই আধিপত্য আর তার জেরে বিভেদ থাকা কাম্য নয়। মানুষকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করা অবশ্যই উচিত, কিন্তু আধিপত্যের কারণে কাউকে সম্মান দেখালে তাতে ভয় আর নিরাপত্তাহীনতাই মিশে থাকে। নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রেক্ষিতে সে পরিস্থিতি আসা অনুচিত। অন্যদিকে, কোনও মানুষকে ভগবানতুল্য মনে করলে তাঁর মধ্যেও আধিপত্যের বোধ জাঁকিয়ে বসে। মানবিক দৃষ্টিতে মানুষকে দেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেই আধিপত্য, এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, “আদালতকে মন্দির বললেই মনে হয় বিচারকরা দেবতা। কিন্তু তা নয়, আমি বরং বিচারকদের মানুষের সেবক বলে মনে করতেই পছন্দ করি।” কারণ তেমনটা মনে করলেই মানুষকে মানবিক চোখে দেখা যায়, তার প্রতি সহমর্মী হওয়া যায়। আর একজন মানুষের বিচার করা, তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেওয়ার মতো বিপুল ক্ষমতা যার হাতে রয়েছে, তাকে মানুষের প্রতি সহমর্মী হয়েই বিচার করতে হবে বলে মনে করেন চন্দ্রচূড়। তাই আগেভাগেই বাদী-বিবাদীর সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে ফেলা, এবং সেই মোতাবেক বিচার করা যে সংগত নয়, বিচারপতিদেরও সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
আরও শুনুন:
হকার উচ্ছেদ নিয়ে তুলকালাম কলকাতায়, অথচ পুরনো শহরেও হাজির ছিলেন ফেরিওয়ালারা
আসলে, আদালতকে মন্দির বলে মনে করলে তার রায় নিয়ে কোনও প্রশ্ন করার অবকাশও থাকে না। ধর্মের বেলায় যেভাবে যুক্তির পথ রোধ করে আবেগ, বিচারের ক্ষেত্রে তেমনটা হওয়া তো বাঞ্ছনীয় নয়। বস্তুত সাম্প্রতিক কালেও বহু রায় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, রায় পুনর্বিবেচনার দাবিও উঠেছে। যিনি বিচার করছেন, তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক ধ্যানধারণা রয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে সেই আদর্শ তাঁকে প্রভাবিত করলে বিচার নিরপেক্ষ নাও হতে পারে। কিন্তু খোদ বিচারপতিকে ভগবান বানিয়ে ফেললে সেই পক্ষপাতিত্বও যে চোখ এড়িয়ে যাবে। আর তা আদালতের নিরপেক্ষতার প্রতিই সুবিচার করবে না। তাই আদালতের উপর দৈবী মহিমা আরোপ করা যে আদতে সংকট হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়েই বিচারপ্রার্থী মানুষ এবং বিচারপতি উভয় পক্ষকেই সতর্ক করে দিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি।