রাখিবন্ধনে যেন ব্রাত্য না থাকেন মুসলিম মহিলারা। বরং তাঁদের কাছে পৌঁছতে হবে এই উৎসবে। সম্প্রতি বিজেপি নেতা-নেত্রীদের এমন নির্দেশই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাখিবন্ধনের মতো উৎসব- যা ছিল সম্প্রীতির চিহ্ন, তাই-ই কি এবার তবে হয়ে উঠল ভোটের অস্ত্র! নানা মহলে উঠছে এই প্রশ্ন। কী তার ভিত্তি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রাখির ডোরে বাঁধা পড়ুক হিন্দু-মুসলমান। সম্প্রতি এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুধু ইচ্ছা প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি। বিজেপি সাংসদদের তিনি নির্দেশও দিয়েছেন যে, এবারের রাখিবন্ধনে যেন তাঁরা মুসলিম মহিলাদের কাছে পৌঁছন। সম্প্রীতির এমন উৎসবে যেন মুসলিম বোনেরা ব্রাত্য না থাকেন। বাংলা, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকের সময়ই প্রধানমন্ত্রী এমন নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।
আরও শুনুন: সরকারের প্রতিবাদে আর যাবে না পুরস্কার ফেরানো, নয়া আইনের ভাবনা কেন্দ্রের
আপাতভাবে এ ইচ্ছা যে মহৎ, তা নিয়ে সন্দেহ করা চলে না। রাখিবন্ধনকে হিন্দু উৎসব দেখার একটি চল বরাবরই আছে। কিন্তু ধর্মীয় সেই খোলস ছাড়িয়ে বন্ধনের তাৎপর্যটিই এখানে গুরুত্ব পায়। আর বাংলার মাটিতে রাখিবন্ধনের আলাদা গুরুত্ব ও ঐতিহ্য আছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে তোলার সময় মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের রাস্তাটি তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রাখিবন্ধনেই। সেকালে যা অকল্পনীয় ছিল, তাই-ই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মুসলমানদের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন রাখি। অবন ঠাকুর সেদিনের স্মৃতিচারণা করে জানিয়েছিলেন, ‘পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিস ঘোড়া মলছে, হঠাৎ রবিকাকারা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পরিয়ে দিলেন। ভাবলুম রবিকাকারা করলেন কী, ওরা যে মুসলমান, মুসলমানকে রাখী পরালে— এইবারে একটা মারপিট হবে। মারপিট আর হবে কী। রাখী পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ব, কাণ্ড দেখে। আসছি, হঠাৎ রবিকাকার খেয়াল গেল চিৎপুরের বড়ো মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখী পরাবেন। হুকুম হল, চলো সব।’ বাকিরা ভাবলেন, এইবার একটা মারামারি রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটবে। চারিদিকে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক বাদে যখন সকলে ফিরলেন, তখন কৌতূহল যে, কী ঘটল মসজিদে? জানা গেল, মারামারি হওয়া দূরের কথা, মসজিদে মৌলবিদের যখন রাখি পরানো হচ্ছিল, তখন তাঁরা সানন্দেই রাখি পরেছেন। তাঁদের মুখে লেগেছিল হাসি। বোঝা যায়, এক বৃহত্তর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে সময় সকলেই প্রীতি ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন। আর সেই বন্ধনের শিখাটি উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
আরও শুনুন: স্মৃতির অতলে ৭৫০০ শহিদ, তাঁদের গ্রাম থেকে আনা মাটিতেই সাজবে ‘কর্তব্য পথ’
সেই রাখিবন্ধনকেই ফিরিয়ে আনছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এক্ষেত্রে বৃহত্তর তাৎপর্য কী? এই প্রশ্নটাই উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। প্রধানমন্ত্রী হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা চিন্তা করছেন, এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু যে ঐক্য তাঁর নির্দেশের অপেক্ষা করে, তার ভিতর যে অনেকখানি হুকুম তামিলের দায় মিশে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রীতিতে তো জোরাজুরি চলে না। তা একান্তই অনুভবের বিষয়। তাহলে সেখানে মোদিকে নির্দেশই বা দিতে হচ্ছে কেন? সাম্প্রতিক রাজনীতির ভিতরই যেন এর উত্তর রাখা আছে। সত্যি বলতে, সাম্প্রদায়িক হিংসায় ভারতবর্ষের সর্বত্র এই মুহূর্তে ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। কী মণিপুর, কী হরিয়ানা- গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসার ঘটনা যেন ক্রমশ দাঁত-নখ বের করে প্রকাশিত হচ্ছে। তা যে কীভাবে আটকানো সম্ভব, তার কোনও দিশা নেই। দেশ প্রতিদিন দীর্ণ হচ্ছে এই হিংসার আঘাতে। তারই মধ্যে হঠাৎ এল এই সম্প্রীতির নির্দেশ। হঠাৎ বলা হল বটে, তবে বাস্তবিক তা আকস্মিক নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই পসমিন্দা মুসলমানদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিজেপি। সরকারের উন্নয়নের খতিয়ান যাতে সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছায়, সে ব্যাপারেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দলীয় নেতাদের। দিনকয়েক আগেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে জোর সওয়াল করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যার মুখ্য দিক ছিল এই যে, এক পরিবারে সকলের জন্য আলাদা নিয়ম হতে পারে না। আর এই বিধি চালু হলে যে মুসলমান মহিলারা উপকৃত হবেন, তা জোর দিয়েই জানিয়েছিলেন তিনি। ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই মুসলিম রমণীদের কাছে রাখির বন্ধন নিয়ে পৌঁছানোর এই নির্দেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিন তালাক রদের মতোই, এক্ষেত্রেও মুসলিম মহিলা ভোট টানাই কি লক্ষ্য? এ প্রশ্ন যদি ওঠে, তবে তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেই লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে নয়া এই কর্মসূচি।
এর জেরে হয়তো লাভবান হবে বিজেপি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর ক্ষেত্রে বিরোধিতার পাথর হয়তো সামনে থেকে অনেকটাই সরে যাবে। সে প্রসঙ্গ আলাদা। তবে নির্দেশ দিয়ে যে সম্প্রীতি পালন করা হচ্ছে, তা কি আখেরে দেশের বন্ধন মজবুত করবে? এই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। বিশেষত, যে সময় নানারকম হিংসার ঘটনায় উত্তপ্ত দেশ, সে সময় সম্প্রীতির এই চিরন্তন উপায়গুলি যদি ভোটের রাজনীতি দখল করে নেয়, তবে সাধারণ মানুষ যেন খানিক ফাঁপরেই পড়ে। যে দেশে শুধু বীরের দরকার হয়, সে যেমন দুর্ভাগা, তেমনই যে দেশে রাখিবন্ধনে প্রধানমন্ত্রীর হুকুম লাগে, সে-ও একইরকম দুর্ভাগ্য। রাখি আর ভোটের যে বন্ধন প্রধানমন্ত্রী করলেন, তা এ দেশের সম্প্রীতির দুর্ভাগ্যকেই যেন আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরল।