বড় কোনও অপরাধ ঘটলেই কথা ওঠে, আরও বেশি করে সিসিটিভি লাগানো হোক। কিন্তু বাড়তি নজরদারি মানেই কি বাড়তি সুরক্ষা? পরিসংখ্যান কিন্তু ঠিক সে কথা বলছে না। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
যাদবপুরের র্যাগিং কাণ্ডের পরেই হোক কি আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ-মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে, বারেবারে কথা উঠেছে ঘটনাস্থলে সিসিটিভি লাগানো নিয়ে। সিসিটিভির সংখ্যা কম কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুধু এ রাজ্যেই নয়, সারা দেশেই যে কোনও সাড়া-জাগানো অপরাধের পরেই এলাকায় থাকা সিসিটিভির খোঁজ পড়ে। এ কথা বলাই বাহুল্য, অকুস্থলে যত সিসিটিভি থাকবে, অপরাধের সময়কার বর্ণনা পাওয়া যাবে ততই নিখুঁতভাবে। তদন্ত এবং বিচারের প্রক্রিয়াও তত সুষ্ঠুভাবে এগোবে। যদিও সিসিটিভি ফুটেজ এডিট করা, নষ্ট করা, এমন নানা উপায়ে সেই বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণও হাপিস করা সম্ভব, সে কথাও আমাদের জানা। তবুও, প্রাথমিকভাবে অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে সিসিটিভির বিকল্প মেলা ভার, এ কথা অস্বীকারের জায়গা নেই। তাই দেখা গিয়েছে, বড় কোনও অপরাধের পরে আদালতের নির্দেশ অথবা প্রশাসনের উদ্যোগেও সিসিটিভি লাগানোর প্রসঙ্গ এসেছে বারবার।
অথচ, বেশি সিসিটিভি লাগানো হলেই কি বাড়তি নিরাপত্তা মেলে? অপরাধ করলেই ধরা পড়ে যেতে হবে, এই ভয়ে অপরাধের হার কমে কি? পরিসংখ্যান কিন্তু ঠিক সে কথা বলছে না। বরং বলছে, দেশের মধ্যে যেসব শহরে সবচেয়ে বেশি সিসিটিভি রয়েছে, সেইসব শহরের অনেকগুলিও নিরাপত্তাহীনতার বিচারে প্রথমের দিকে ঠাঁই করে নিয়েছে দিব্যি।
২০২২ সালে এক মার্কিন সংস্থা সমীক্ষা করে জানিয়েছিল, শুধু দেশে নয়, গোটা বিশ্বের মধ্যেই সর্বাধিক সিসিটিভি নজরদারি চালানো শহরের তালিকায় রয়েছে একাধিক ভারতীয় শহর। কিন্তু অপরাধের হারের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকাতেও সেই শহরগুলি রয়েছে। যেমন ধরা যাক, হায়দরাবাদ, সিসিটিভি নজরদারির হিসেবে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়। প্রতি হাজার জন পিছু এখানে প্রায় ৪২টি সিসিটিভি রয়েছে। কিন্তু এ শহরের অপরাধ সূচক তা বলে কমেনি মোটেই, ক্রাইম ইনডেক্স গিয়ে ঠেকেছে ৪২.৯-এ। সত্যি বলতে, গোটা দেশেই অপরাধের হার বাড়ার হার আশঙ্কা জাগায়। বিশেষ করে নারী নির্যাতনের প্রবণতাটি আইন-আদালত-নজরদারি কোনও কিছুতেই বিশেষ চাপা পড়ছে না। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিসিটিভি থাকা শহর ইন্দোর। হাজার জন পিছু গড়ে সাড়ে ৬২টি সিসিটিভি রয়েছে এ শহরে। অথচ ২০২২ সালের প্রথম ৫ মাসেই এ শহরে ধর্ষণ-হেনস্তা জাতীয় অপরাধ ১৪ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। শহরের ক্রাইম ইনডেক্স ৪৮.৩৭। অথচ এর ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে কোঝিকোড়ের ক্রাইম ইনডেক্স ৪৫.৩, যে শহরে প্রতি হাজার জন পিছু সিসিটিভি রয়েছে মাত্র ০.০৫টি। ২০২১ সালেই ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানিয়েছিল, আগের বছরের তুলনায় নারীকে হেনস্তা সংক্রান্ত অপরাধের হার ১৫.৩ শতাংশ বেড়েছে। সেই সময়সীমাতেই, শুধুমাত্র রাজধানী দিল্লিতেই ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল এ জাতীয় অপরাধ। যদিও সেখানে হাজার জন পিছু প্রায় ২৭টি ক্যামেরা রয়েছে। ২০২১ সালেই দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল রীতিমতো গর্ব করেই জানিয়েছিলেন, প্রতি বর্গফুটে গড়ে কত সিসিটিভি রয়েছে, এই বিচারে সাংহাই, লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো শহরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে দিল্লি।
এতগুলো বছরেও সেই হিসেবে বিশেষ রদবদল ঘটেনি। এর মাঝে নির্ভয়া কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, তার জেরে কঠোর আইন এসেছে, দেশে কাঠুয়া-হাথরাস-উন্নাও-এর মতো নারকীয় ধর্ষণ কাণ্ড ঘটেছে, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কও কম হয়নি, তবে অপরাধপ্রবণতা আর কমছে কই! আসলে কেবল সিসিটিভি লাগিয়ে রাখলেই তো সমস্যার সমাধান ঘটে না, তা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, বিকল হয়ে গিয়েছে কি না, প্রয়োজনীয় স্থানের ফুটেজ ধরছে কি না, এ সবকিছুর খেয়াল তো মানুষকেই রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রয়োজনে সিসিটিভি দেখে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আর তা হলে সিসিটিভির সংখ্যা যতই বাড়ুক, তা অপ্রয়োজনীয়, বাড়তি বোঝা হয়েই রয়ে যাবে। সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যাবৃদ্ধি সত্ত্বেও যেভাবে ভারতে অপরাধের হার বাড়ছে, সেখানে এই বাড়তি নজরদারি নিয়ে মেয়েরা উদ্বিগ্নই হচ্ছেন আরও বেশি করে। সর্বক্ষণ কোনও নজরদারির আওতায় থাকতে কোনও স্বাধীন মানুষই পছন্দ করবেন না, সে তো বলাই বাহুল্য। উপরন্তু নারীরা মনে করছেন, যেভাবে একাধিক পুরুষ-দৃষ্টি তাঁদের অশালীনভাবে ছুঁয়ে যায় প্রতিনিয়ত, সিসিটিভিও যেন তেমনভাবেই তাঁদের উপর আরও একটা বাড়তি নজর। তা যখন তাঁদের নিরাপত্তাই দিতে পারছে না, তাহলে বাড়তি এই অবাঞ্ছিত নজর নিয়ে কী করবেন তাঁরা? প্রশ্ন তুলছেন মহিলারা।