শেখ হাসিনার রাজত্বে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়৷ হাসিনা গদিচ্যুত, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল থাকলে দুদেশের মধ্যেকার রপ্তানি-আমদানির অঙ্কটা অনেকটাই বদলে যেতে পারে৷ ইউনুসের নেতৃত্বে নয়া সরকার গড়া হলে কোন পথে হাঁটতে পারে দুই দেশের বাণিজ্যনীতি? খতিয়ে দেখলেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
ছাত্র আন্দোলনকে ভর করে গণ অভ্যুত্থান হওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। আপাতত বাংলাদেশ সেনার দখলে, তবে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে নতুন সরকারের পথে দেশ৷ কিন্তু নয়া প্রশাসন থিতু হওয়ার আগে দেশজুড়ে নৈরাজ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ বিজয় উল্লাসের পাশাপাশি একের পর এক গণপিটুনি, হত্যাকান্ড এবং অগ্নি সংযোগের মতো ঘটনা ঘটছে৷ এই অশান্ত বাংলাদেশে খুন হতে দেখা গিয়েছে প্রযোজক সেলিম খান ও তাঁর ছেলে অভিনেতা শান্ত খানকে৷ ওপার বাংলার সেলিম আবার এপার বাংলার সাংসদ নায়ক দেবের সিনেমার সহ-প্রযোজক ছিলেন৷
আরও শুনুন:
‘নতুন’ বাংলাদেশে গুরুদায়িত্বে নোবেলজয়ী ইউনুস, অর্থনীতির সংকট মিটবে?
দুই বাংলার যৌথ উদ্যোগে অনেক সময়ই ছবি নির্মিত হয়৷ কিন্তু বর্তমান পরিবেশ সেই উদ্যোগের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো? কেন-না এ দেশের সিনেমা জগতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তিত্বদের যোগ রয়েছে, তাদের অনেকেই বেশ আতঙ্কে রয়েছেন৷ শুধু চলচ্চিত্র শিল্প বলে নয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুদেশের শিল্প বাণিজ্যের পরিবেশ ঘিরেই একধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে৷ শেখ হাসিনার রাজত্বে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়৷ এবার হাসিনা গদিচ্যুত হওয়ায় এবং পরবর্তীকালে প্রতিবেশী বাংলাদেশ অস্থিতিশীল থাকলে দুদেশের মধ্যেকার রপ্তানি-আমদানির অঙ্কটা অনেকটাই বদলে যেতে পারে৷ তা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে একটি প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) অগ্রগতি বিলম্বিত হতে পারে।
চিকিৎসা ঘিরে পর্যটন এবং কর্পোরেট সম্প্রসারণ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত রয়েছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সেখানে কোনও কারণে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির ঘটলে, উপরন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবহণ ব্যবস্থা ধাক্কা খেলে, পণ্য আদানপ্রদান তো থমকে যাবেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে এ দেশে চিকিৎসার জন্য রোগীদের আসাও ব্যাহত হতে পারে৷ যেটা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক বিষয় নয়, এর নেপথ্যে যে একটা মানবিক দিকও রয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷
বিশ্বের পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, এবং সেজন্য প্রতিবেশী ভারত থেকে তুলো আমদানি করতে হয়। তা ছাড়া ওখান থেকে প্রধান আমদানি সামগ্রী হল- মাছ, প্লাস্টিক, চামড়া এবং পোশাক। আর বাংলাদেশে ভারতের বৈচিত্র্যময় রপ্তানি, যার মধ্যে রয়েছে কৃষি, বস্ত্র, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স, অটো যন্ত্রাংশ, লোহা ও ইস্পাত, বিদ্যুৎ এবং প্লাস্টিক। এই রপ্তানির বেশিরভাগই সম্পূর্ণ শুল্কের অধীনে এবং দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) চুক্তির আওতায় পড়ে না। বিপরীতভাবে, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির বেশি নজর থাকে টেক্সটাইল, গার্মেন্টসে, এবং যা তাদের মোট রপ্তানির ৫৬%, যেগুলি সাফটা-এর অধীনে বিনা শুল্কের সুবিধা পায়।
আরও শুনুন:
বাংলাদেশে হিন্দুদের বাঁচান! ৭১-এর ইন্দিরার পথেই মোদিকে দেখতে চান বিজেপি নেতা
তবে আশঙ্কা থাকলেও সম্প্রতি এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিং-এর অভিমত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বাধা বিপত্তির জেরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বৈচিত্র্যময় রপ্তানি বাণিজ্য ধাক্কা খেতে পারে, তবে তাতে এ দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যের দিক থেকে তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব পড়বে না৷ ভারত সারা বিশ্বেই নানারকম রপ্তানিতে নিয়োজিত, সেই তুলনায় ভারত বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিধি অনেক কম৷ ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির মাত্র ২.৫% যায় বাংলাদেশে। তবে যে নির্দিষ্ট শিল্প বিভাগ থেকে বড় রপ্তানি বাংলাদেশেই হয়, সেখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তেই পারে৷ যেমন- তুলো ও সুতোর ক্ষেত্রে। তবে এও ঠিক, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে থাকলে বা দু-দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা দেখা দিতে পারে৷
২০১৬ সাল থেকে, ভারত বাংলাদেশে সড়ক, রেল, জাহাজ এবং বন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য আট বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করেছে। মূল প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ এবং খুলনা-মংলা বন্দর রেললাইন৷ দুটিই ২০২৩ সালের নভেম্বরে উদ্বোধন করা হয়েছিল, যার লক্ষ্য বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করা। কিন্তু ক্রমাগত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে এই সংযোগগুলিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে৷ একদিকে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে ইতিমধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। আবার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের পচনশীল পণ্য রপ্তানি সীমান্তে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। বাংলাদেশের অস্থিরতার কারণে নিরাপত্তা বাড়াতে সীমান্ত বন্ধ করলে সেটাও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে শান্তি ফেরে, ততই মঙ্গল দুদেশের পক্ষে৷ আর আগামী দিনে এই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক যত স্বাভাবিক হবে, সব দিক দিয়েই দ্বিপাক্ষির বাণিজ্যের বিস্তার ঘটা সম্ভব হবে৷ আপাতত সেদিকেই তাকিয়ে দেশের কূটনৈতিক মহল।