ভগবানকে স্মরণ করলে সাত জন্মের জন্য স্বর্গবাস নিশ্চিত হত। এই যে ধারণা, সেই পথ ধরেই অদৃষ্টবাদ তথা নিয়তিবাদের প্রবেশ। স্বর্গের দেখা পাওয়া যায় কিনা জানা নেই, তবে এই বক্তব্যের মূল সূরটি যেমন প্রাচীন তেমন স্পষ্ট। মানুষের দুর্দশার কারণটি আসলে দৈবসূত্রে গাঁথা।
দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে আম্বেদকর। এমন একটা সময়, যখন তাঁর চিন্তাভাবনা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় মুছে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে অহরহ। যে সংবিধানে দেশের আত্মাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস তিনি করেছিলেন, সেই সংবিধান বদলে দেওয়ার অভিযোগেও সরগরম সাম্প্রতিক রাজনীতি। যে সময় দেশ ধর্মচালিত রাজনীতির কবলে পড়ে হাঁসফাস করে বলে আক্ষেপ করে থাকেন সমাজতত্ত্ববিদরা, ঠিক সেই সময় দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন বাবাসাহেব আম্বেদকর।
তবে যে সূত্রে তাঁকে নিয়ে আলোচনা, তা যেন এই সময়ের চিহ্নটিকেই চিনিয়ে দেয়। বিতর্কের সূত্রপাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তাঁর বক্তব্যের মূল কথাটি হল, এখন বারবার আম্বেদকরকে স্মরণ করা যেন একটি ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে তাঁর সংযোজন, এত বার যদি কেউ ঈশ্বরের নাম নিতেন তাহলে স্বর্গবাস নিশ্চিত হত। এই বক্তব্য নিয়েই বিরোধীদের আপত্তি। যদিও শাসকদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, শাহের মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি যে প্রেক্ষিতে যে কথাটি বলতে চেয়েছিলেন, তার অর্থ ঠিকঠাক ভাবে সকলের কাছে পৌঁছয়নি। ফলে তা নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা করার চেনা অভিযোগ এসেছে। এই রাজনৈতিক চাপানউতোরের কথা নাহয় ছেড়েই দেওয়া গেল। তবে, প্রসঙ্গটি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
এই পুরো বিতর্কে বোধহয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই ঈশ্বর-স্মরণ প্রসঙ্গটিই। ভগবানকে স্মরণ করলে সাত জন্মের জন্য স্বর্গবাস নিশ্চিত হত। এই যে ধারণা, সেই পথ ধরেই অদৃষ্টবাদ তথা নিয়তিবাদের প্রবেশ। স্বর্গের দেখা পাওয়া যায় কিনা জানা নেই, তবে এই বক্তব্যের মূল সূরটি যেমন প্রাচীন তেমন স্পষ্ট। মানুষের দুর্দশার কারণটি আসলে দৈবসূত্রে গাঁথা। যে ধারণা থেকেই পাপ, পুণ্য, কর্মফল ইত্যাদি হাজারও প্রসঙ্গের অবতারণা। এবং দীর্ঘদিন ধরে তা লালন-পালনের ফলে ভারতবাসীর মনে এর একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে বলাই যায়। এই নিয়তির কাছে মানুষ যদি আত্মসমর্পণ করে তাহলে আর কাউকে দোষ দেওয়ার থাকে না। মানুষকে যে শোষণ করে, দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়, তার বিরুদ্ধে মানুষের আর প্রতিরোধ-প্রতিবাদের কিছু থাকে না। সকলই নিয়তি, সকলই অদৃষ্ট। এই অদৃষ্টবাদের বিরুদ্ধেই মানুষের সংগ্রাম। নিয়তির হাতে মানুষ যে পুতুল এই ধারণা বহুকাল মানুষকে কবজা করে রেখেছে। জাত-পাতে ক্লিষ্ট সমাজ যেভাবে মানুষকে তার স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে, নিয়তির হাতে সর্বস্ব ঠেলে দিলে তাহলে আর বলার কিছু থাকে না। ঠিক এই বিন্দু থেকেই আম্বেদকরের লড়াই আর আজীবনের কর্মকাণ্ডটিকে ফিরে দেখা যায়। ঘটনাচক্রে সেই বিন্দুটিই আবার ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে দেশের রাজনীতিতে।
ভারতবর্ষের নিম্নবর্গের মানুষদের উচ্চবর্ণের হাতে যে অন্যায় সহ্য করতে হয়েছে, তার প্রতিরোধকে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির রূপ দিয়েছিলেন আম্বেদকর-ই। দলিতের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে তাই তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘সত্যাগ্রহ’। বর্ণাশ্রম প্রথার মধ্যে যে নিয়তিবাদ লুকিয়ে, তা এই বর্গের ফারাক কোনভাবেই মুছতে দেয় না। ফলত ভেদাভেদের রাজনীতি থেকেই যায়। সংস্কার কর্মসূচির নামে প্রকারন্তরে এই ভেদকে স্বীকার করে নিয়েই শোষিত মানুষদের জন্য কিঞ্চিৎ সম্মানের বন্দোবস্ত করা হয়। তাতে অধিকার আদায় হয় না। আবার, এই অবস্থানকে পুরোপুরি স্বীকার না করে, তাকে একটি শ্রেণি বা বর্গের আখ্যা দিতে চায় যে রাজনীতি, তাও হয়তো এই বর্গের মানুষের আন্দোলনকে সম্যক ধরতে পারে না। অতএব অদৃষ্টের বা নিয়তির নাম করে যা চলে আসছে, তার বিরুদ্ধতায় একটি সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রহণই ছিল সঠিক পদক্ষেপ। আম্বেদকর তা করেছিলেন। মনুবাদী আদর্শের শোষণের ধারণাকে রাজনৈতিক পদক্ষেপেই তিনি মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। এবং পরবর্তীতে যখন নতুন দেশ গঠন করার প্রয়াস নেন, তখনও এই ভাবনাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
তার পর বহু জল গড়িয়েছে গঙ্গা-যমুনায়। দেশ সমাজত্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এখন অনেকটাই সরে গিয়েছে। তবে, তা আকস্মিক নয়। সবটাই কার্যকারণে গাঁথা। ক্রমে ক্রমে দেশের রাজনীতি রিলিজিয়নের হাত ধরে এগোনোর পক্ষপাতী হয়েছে। তা নিয়ে সমালোচনা হয়, বিতর্ক হয়। আর তা ঘটছে বলেই আবার বোধহয় নিয়তিবাদের প্রসঙ্গ আবার ফিরে আসে দেশের রাজনীতিবিদের বক্তব্যে। আর ঘটনাচক্রে সে কথা আসে আম্বেদকরের সূত্র ধরেই।
এ যদি আয়রনি না হয় তবে আর কী!