ছবির মতো সাজানো, সুন্দর দেশটায় একদিন পড়তে গিয়েছিলেন কেউ কেউ। কেউ বা গিয়েছিলেন অন্য কাজে। কিন্তু রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণার পরেই ছারখার হয়ে গিয়েছে ইউক্রেন। এখন কান পাতলে যুদ্ধের সাইরেন শুধু। শত্রুদেশের যুদ্ধবিমান আর সেনার টহল। প্রাণভয়ে পালাচ্ছেন সকলে এদিক ওদিক। বিপদে পড়েছেন ভারতীয়রাও। সীমান্ত টপকে কেউ পৌঁছে যেতে চাইছেন নিরাপদ কোনও আশ্রয়ে। সকলে আবার তা-ও পাচ্ছেন না। বিপদগ্রস্ত ভারতীয় ও অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করছে ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলোও। তাই শহরের সবচেয়ে সুন্দর বিয়েবাড়িটা ওঁদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট। সেখানে কোনও মতে মাথা গুঁজেছেন অসংখ্য ভারতীয়।
মানুষের একটু ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্যই তো জগৎ সংসারের এত আয়োজন, এত ব্যবস্থা। কিন্তু যুদ্ধ যেন এক নিমেষে সবকিছুকে ব্যর্থ করে দেয়। বাকি সবকিছুকে তুচ্ছ করে মাথা উঁচিয়ে জেগে থাকে শত্রুতা আর রক্তপাত। আর এ সবের মাঝে পড়ে শেষ হয়ে যায় অসংখ্য প্রাণ। ঠিক যেমন পরিস্থিতি এখন ইউক্রেনের।
দেখতে দেখতে ন-দিনে পড়ল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় পরমাণুকেন্দ্রটির দখল নিয়েছে রাশিয়া। সেখানে আগুন লাগার খবরও এসেছে। প্রাণভয়ে ঘর-বাড়ি, দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করেছেন অসংখ্য ইউক্রেনবাসী। শহর ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ। আর ভিড় বাড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলির সীমান্তে। যুদ্ধক্লান্ত ইউক্রেন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শরণার্থী এসে ঢুকছে সেসব দেশে। তার মধ্যে শুধু যে ইউক্রেনের বাসিন্দাই রয়েছেন তা নয়। রয়েছেন আশপাশের দেশগুলি থেকে আসা বহু প্রবাসীও। রয়েছেন ভারতীয়রাও।
আরও শুনুন: আটক রুশ সেনাকে খাবার, মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ে মানবিকতার নজির ইউক্রেনবাসীর
ইতিমধ্যেই ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনতে ভারত সরকার শুরু করেছে ‘অপারেশন গঙ্গা’। তবে ইউক্রেনের আকাশপথ বন্ধ থাকায় সরাসরি উদ্ধারকাজে বাধা পড়ছে। তাই রোমানিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেই ভারতীয়দের ফেরানোর চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। এখনও পর্যন্ত যুদ্ধের মধ্যে পড়ে তিন ভারতীয় পড়ুয়ার প্রাণ গিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন অজস্র ভারতীয়।
পালিয়ে তো এসেছেন অন্য দেশে। সেখানে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন! ঘোর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি তাঁরা। তবে এই এতকিছুর মধ্যেও অমলিন মানবিকতা। আর তাই সবাই নিজের মতো করে চেষ্টা করছে, বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোকে একটু হলেও নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার। তারই নজির রোমানিয়ায়। ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা ভারতীয় পড়ুয়াদের জন্য সেখানে খুলে দেওয়া হয়েছে আস্ত একটা বিয়েবাড়ি। বিয়েবাড়ি বা অন্য অনুষ্ঠানের জন্যই ভাড়া দেওয়া হত সেই বাড়িটি। বিপদের দিনে সেই অনুষ্ঠান বাড়িটিকেই শরণার্থীদের জন্য খুলে দিয়েছে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট। সত্যিই তো, আগে তো মানুষের প্রাণ, তবেই তো উৎসব ও আনন্দ। বুখারেস্টের এই সৌজন্যে মুগ্ধ আটকে পড়া ভারতীয়রা। তাঁরা জানিয়েছেন, “হিংসার দেশ থেকে হঠাৎ যেন যত্নের রাজ্যে এসে পড়েছি আমরা।”
আরও শুনুন: যুদ্ধ এড়াতে আফগানিস্তান ছেড়ে ইউক্রেনে ঠাঁই, ফের যুদ্ধই ঘরছাড়া করল আজমলদের
ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেনে এসে আলাপ হয়েছিল হর্ষ পানওয়ারের সঙ্গে রেভা শ্রীবাস্তবের। হয়েছিল মন দেওয়া-নেওয়া। ভবিষ্যতে একসঙ্গে ঘর বাঁধারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এই একটা যুদ্ধ যেন সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। এখন বেঁচে দেশে ফেরাটাই যেন একমাত্র প্রার্থনা ওদের। প্রায় দুদিন ধরে যাযাবরের মতো ঘুরেছেন রাস্তায় রাস্তায়। পেটে খাবার নেই, মাথায় ছাদ নেই। বাঁচবেন কিনা আদৌ, নেই তার নিশ্চয়তাটুকুও। সেই দিন যাপনের পরে বুখারেস্টের ওই বিয়েবাড়ির আশ্রয়টুকু তাঁদের কাছে কোনও স্বপ্নের চেয়ে কম নয়। প্রায় এক সপ্তাহ বাদে শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছেন হর্ষ-রেভারা। ওঁরা শুধু নয়, যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে ওই বিয়েবাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে বহু মানুষ।
মাথার উপর আলোর চাঁদোয়া, সুন্দর করে পাতা পরপর বিছানা- বুখারেস্টের ওই বিয়েবাড়ির আয়োজন দেখে একঝলক চমকেই উঠেছিলেন শরণার্থীরা। যেন কোনও উৎসব আজ। উদযাপনের দিন। কিন্তু কী উদযাপন করবেন ওঁরা? হয়তো ভয়ঙ্কর যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া। আবার নিজের দেশে, পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারবেন আবার, সেই আশাটুকু কিংবা অনেক দিন পরে শান্তির একটু ঘুম। এটাই ওঁদের কাছে অনেকটা আজ। রোমানিয়ার এই আতিথেয়তা যেন সেই জীবনের স্বপ্নটুকুই ফিরিয়ে দিয়েছে ওঁদের।