বন্যায় ভেসেছে আপনজন। কোনওক্রমে প্রাণ হাতে পালিয়েছেন বাকিরা। ওয়ানড়ে মৃতদের সৎকার করবে কে? দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন মসজিদ-মন্দির-গীর্জা কর্তৃপক্ষ। ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে মৃতদেহের শেষকাজ নিষ্ঠাভরে পালন করছেন তাঁরাই। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মৃত মানুষের কে আপন কে পর! ওয়ানড় বিপর্যয় আরও একবার বুঝিয়ে দিল সেকথা। যে কোনও ধর্মের মৃতদেহ সৎকারের বিশেষ নিয়ম রয়েছে। সাধারণত সেই কাজ করেন পরিবারের সদস্যরাই। কিন্তু বিপর্যয়ের সময় নিজের মানুষের খোঁজ পাওয়া দায়। তাই ওয়ানড়ের শতাধিক মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করল স্থানীয় মসজিদ-গীর্জা-মন্দির কর্তৃপক্ষ।
:আরও শুনুন:
বড্ড বেশি মানুষ গেল বানের জলে ভেসে! প্রকৃতির পূর্বাভাসকে গুরুত্ব দিতে শেখাবে ওয়ানড়?
একদিকে ধসের কারণে খাদ, আলগা মাটি পাথরের স্তূপ, মৃতদেহের টুকরো। অন্যদিকে লাগাতার বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। প্রকৃতির রুদ্ররোষে বিপর্যস্ত ঈশ্বরের নিজের রাজ্য কেরল। ভয়াবহ ভূমিধসে হারিয়ে গিয়েছে তিনশোর বেশি প্রাণ। মানচিত্র থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে একাধিক জনপদ। সেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা জীবন বাজি রেখে সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়েছেন। কোথাও যদি এতটুকু প্রাণের হদিশ মেলে, সেই খোঁজ চলছে জোর কদমে। কিন্তু মৃত্যুপুরী ওয়ানড়ে যেদিকে তাকাও সেদিকে প্রাণহীন নিথর দেহ। অনেকেই দাবি করছেন, ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা কোনও দেহেই আর প্রাণের অস্তিত্ব নেই। এইসব মৃতদেহ অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সম্ভব নয়। তাই সেখানেই সৎকারের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় মসজিদ কর্তৃপক্ষ। কেরলের মেপ্পেডিতে মন্দির-মসজিদ ও গীর্জার দূরত্ব খুব বেশি নয়। তিন ধর্মস্থানেই আপাতত স্রেফ মৃতদেহ সৎকারের আজ চলছে। সব মৃতদেহ দেখে ধর্ম চেনার উপায় নেই। জানার চেষ্টাও অবশ্য করছেন না কেউ। নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত মানুষের শেষ কাজটুকু তাঁরা করছেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষের দাবি, একই কবরে তিনটি করে মৃতদেহ রাখতে হবে। কারণ সমতলের অধিকাংশই কবরস্থানই ভেসে গিয়েছে। পাহাড়ের খাঁজে জায়গা খুঁজে কবর খোঁড়া হচ্ছে। তার ওপর প্লাস্টিকের ঢাকা ব্যবহার করছেন মসজিদের সদস্যরা। কবর দেওয়ার পরে পরেই যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে কবরে জল ঢুকে তা নষ্ট হয়ে যাবে। বিপর্যয়ের মাঝে এই ব্যবস্থা করা মোটেও সহজ নয়। তাও যতটুকু পারা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা, জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই শতাধিক দেহ অন্তিম সৎকার সম্পন্ন হয়েছে।
:আরও শুনুন:
বিপর্যস্ত ওয়ানড়ে সেতু গড়ে উদ্ধার দুর্গতদের, লিঙ্গবৈষম্য উড়িয়ে কুর্নিশ আদায় মেজর সীতার
মসজিদের কাছেই মারিয়াম্মান কোভিল মন্দির। এখানে হিন্দুমতে সৎকারের কাজ চলছে। একসঙ্গে ১০-১২ টি চিতা সবসময় জ্বলছে মন্দির চত্বরে। সবসময় সম্পূর্ণ দেহও মিলছে না। ক্ষতবিক্ষত দেহের অংশই নিষ্ঠাভরে সৎকার করছেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষের তরফে জনানো হয়েছে, কোনও মৃতদেহই আলাদা নজরে দেখছেন না তাঁরা। ধর্মের ভেদ ভুলে একজন মৃত মানুষের শান্তি কামনা করছেন সকলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানা যাচ্ছে না। তাই হিন্দু মতে সব আচার পালন সম্ভব হচ্ছে না। স্রেফ নিষ্ঠাভরে দেহটির সৎকার করছেন মন্দিরের সদস্যরা। মন্দির থেকে কয়েক পা এগোলেই গীর্জা। সেখানেও ছবিটা খুব একটা আলাদ নয়। তবে গীর্জায় মৃতদেহ কম আসছে বলেই দাবি কর্তৃপক্ষের। ওয়ানড়ে প্রকৃতির তাণ্ডব কবে শেষ হবে কেউ জানে না। মৃতের সংখ্যা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেও জানা নেই কারও। এই আবহে ধর্মের ভেদ যে অপ্রয়োজনীয় তা বুঝেছেন সেখানকার মন্দির-মসজিদ-গীর্জা কর্তৃপক্ষ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে এই সম্প্রীতির ছবি অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকবে, কিন্তু এমনটা হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? প্রশ্ন রেখে গেল ওয়ানড় বিপর্যয়।