নামী প্রতিষ্ঠানের উজ্জ্বল ছাত্র। হাতের নাগালে সাফল্য। তবুও মরে যেতে হয়েছিল ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার জয় লোবো-কে। ঠিক যেভাবে বিগত কয়েক বছরে দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে একের পর এক পড়ুয়া। যে প্রবণতা ক্রমশ উদ্বেগ বাড়াচ্ছে শিক্ষামহলে। শুনে নেওয়া যাক।
পড়াশোনায় ভাল মানেই সাফল্যের সিঁড়িটা অনেকখানি হাতের নাগালে। আর একটা ভাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে যদি তা কোনও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হয়, যেখানে ভালভাবে পাশ করলেই নিশ্চিত চাকরির আশ্বাস। অথচ, এর কোনও কিছুই যেন আশার আলো জ্বালাতে পারছে না একটা বড় অংশের পড়ুয়ার চোখের আঁধারে। সামনে যতই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য স্বপ্নের হাতছানি থাকুক না কেন, দেখা যাচ্ছে, তার কোনও কিছুই যেন আর বেঁচে থাকার রসদটুকু জোগাতে পারছে না তাদের। তাই দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও যেন নেমেছে ছাত্রমৃত্যুর ঢল। দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিগত পাঁচ বছরে অন্তত ৯৮ জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, এমনটাই জানাচ্ছে সরকারি পরিসংখ্যান। সেখানে আইআইটি, আইজার (IISER), এনআইটি-র মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে কোটার মতো প্রতিষ্ঠানও, যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারির সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি চলে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আইআইটি-তেই, মোট ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরেই ঘটে গিয়েছে বিশজন পড়ুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা। এর মধ্যে সাতটি ঘটনা ঘটেছে কোনও না কোনও আইআইটি-তে, নটি আত্মহত্যার ঘটনাস্থল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি।
আরও শুনুন: নতুন যুগের রানার তাঁরা, শ্রমিকের সুবিধা কি আদৌ পাবেন?
কিন্তু কেন এই মৃত্যুর ঢল? জীবনানন্দ যে ‘মরিবার সাধ’-এর কথা বলেছিলেন, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে কোনও অভাব না থাকার পরেও মানুষ জীবনে আনন্দ খুঁজে পায় না, তেমনই কোনও বিষাদ কি লুকিয়ে রয়েছে এই মৃত্যুগুলির নেপথ্যে? নাকি এইসব মৃত্যুর কারণ অন্য কিছু, ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকা অন্য কোনও ঘটনা? ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার জয় লোবো-র মতোই, কীসের জন্য ‘আই কুইট’ বলে এ জীবন ছেড়ে যান এই উজ্জ্বল পড়ুয়ারা?
সময়ে প্রজেক্ট জমা দিতে পারেনি জয়। প্রতিষ্ঠান শিক্ষাকে যে ছকে বেঁধে দেয়, সেই ছকের বাইরে গিয়ে ভাবনাচিন্তা করার মতো ক্ষমতাও ছিল তার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই কবেই ‘তোতাকাহিনী’-র আড়ালে বলে গিয়েছেন, ভিন্ন স্বরকে কোনও প্রতিষ্ঠানই মেনে নিতে চায় না। প্রতিষ্ঠানের সেই শক্ত দেওয়ালগুলো পেরিয়ে একটু রোদ আর খানিকটা বৃষ্টি চেয়েছিল জয়, চেয়েছিল জীবনটাকে নিজের শর্তে আরেকবার বেঁচে নেওয়ার সুযোগ। মনে মনে হয়তো সেই একই সুযোগ চেয়েছিলেন বাস্তবে আত্মহত্যা করা এই পড়ুয়ারাও। মনে রাখা দরকার, এই নামী প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁদের অধিকাংশকেই থাকতে হয় বাড়ি থেকে দূরে। কোটার কোচিং সেন্টারগুলি এমনিও আবাসিক, জীবন সেখানে কড়া অনুশাসনে বাঁধা। অস্বাভাবিক নিয়ম, অগণিত পরীক্ষা, বিশ্রামহীন রুটিনের জন্য একরকম কুখ্যাতিই রয়েছে সেই কেন্দ্রগুলির। ভাড়াবাড়ি বা পেয়িং গেস্ট ব্যবস্থায় কোনও মতে থাকা, দিনে পনেরো-ষোলো ঘণ্টা পড়াশোনা, এক ঘণ্টা বেশি ঘুমোতে চাইলে কর্তৃপক্ষের ভর্ৎসনা ও ধিক্কার— এই জীবন হয়তো নিতে পারেন না অনেক পড়ুয়াই। তাঁরা জীবনে সফল হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হয়তো এভাবে নয়। কীভাবে, তাঁদের কাছে কেউ সে কথা জানতে চায়নি। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কেরিয়ারের বোঝা বইতে গিয়ে তাই হাঁপিয়ে ওঠেন অনেকেই। তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে ভয় হয় হেরে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার। অত্যধিক চাপ থেকে ঘিরে ধরে অবসাদ। আর অবশেষে, অন্য এক জীবনের খোঁজে এ জীবনকে ছুটি দেন তাঁরা।
আরও শুনুন: ভারতের জন্য বদল ‘ওপেনহাইমারে’র নগ্ন দৃশ্যে! খাজুরাহোর দেশেই ছুঁতমার্গ কেন, উঠছে প্রশ্ন
২০১৮ সালে ২১টি, ২০১৯ সালে ১৯টি, ২০২০ এবং ২০২১ সাল অর্থাৎ লকডাউনের বছর দুটিতে ৭টি করে, ২০২২-এ মোট ২৪টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ দেশে। যা নিয়ে গত বছরেই রীতিমতো উদ্বেগের কথা শুনিয়েছিল জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরো-র দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যার রিপোর্ট। যেখানে জানা গিয়েছিল, গত পাঁচ বছর ধরেই ভারতে ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে, ২০২১ সালেই তা বেড়েছে ৪.৫ শতাংশ। অনেকগুলি রাজ্য পড়ুয়াদের পড়ার চাপ হালকা করতে বলেছে, পাঠ্যক্রমে এসেছে যোগ ও শরীরচর্চা, শিক্ষক-ছাত্রের সুষ্ঠু অনুপাতের দিকে নজর দিতে বলা হয়েছে যাতে শিক্ষকেরা পড়ুয়াদের খেয়াল রাখতে পারেন। এমনকি পড়ুয়াদের ঘর থেকে সিলিং ফ্যান খুলে নেওয়া বা ফ্যান জাল দিয়ে ঘেরার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ঘটে যাওয়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, সমস্যাটা আসলে আরও বড়। শিক্ষাকে বাহন করার বদলে বহন করার ধাঁচেই হাঁটছে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। যা আদৌ পড়ুয়ার মনের খবর রাখতে চায় না। এতগুলি প্রাণের ঝরে যাওয়া কি এই সিস্টেমকেই উলটে শিক্ষা দিয়ে গেল না? সে উত্তর হয়তো সময়ই দেবে।