এ দেশ নানা ভাষা নানা মতের। অথচ গত কয়েকদিনে সেই সমন্বয়ের শিকড়েই বারবার পড়েছে টান। সে মসজিদ-মন্দির রেষারেষি হোক বা ধর্মকে কেন্দ্র করে অশান্তির ছায়া। এবার সেই বিতর্ক বাড়ল পঞ্জাবের বিখ্যাত স্বর্ণমন্দির ঘিরেও। সেখানে পরিবেশিত কীর্তনের সঙ্গে এবার হারমোনিয়াম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপত্তি তুলল হরমন্দির শাহিবের অকাল তখত। তিন বছরের মধ্যে হারমোনিয়ামকে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে হুঁশিয়ারিও দিয়েছে তারা। তার নেপথ্যের কারণখানা অবশ্য অবাক করার মতোই। কেন হারমোনিয়াম ব্যবহার ঘিরে আপত্তির মেঘ? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ভারতীয় সংস্কৃতি আদতে কোনও একটি জাতি বা একটি ধর্মের নয়। বহুমুখীতাই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর সেই মিশ্র সংস্কৃতির ছাপই এতদিন ধরে লেগেছিল এ দেশের আনাচেকানাচে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে সেই সংহতির শিকড়ে যেন নাড়া লেগেছে। এখান-ওখান থেকে শোনা গিয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ, হানাহানির খবর। কোথাও মসজিদে লাউড স্পিকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা তো কোথাও আবার হনুমান চালিশা পড়ার হুমকি। জ্ঞানবাপী, ইদগাহর মতো একাধিক মসজিদের ভিতরে হিন্দু দেবদেবীর অস্তিত্ব থাকার দাবি জানিয়েছে দেশের একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এমনকী একই দাবি উঠেছে তাজমহল ও কুতুব মিনারকে ঘিরেও। সব মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তির বীজ ভাসছে হাওয়ায়।
আরও শুনুন: আসল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই জ্ঞানবাপী বিতর্কে জোর, দাবি স্থানীয় মুসলিমদের
এবার সেই বিতর্কে নাম লেখাল পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দির। শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান এই হরমন্দির শাহিব বা স্বর্ণমন্দির। তবে শুধু শিখরাই নন, প্রতিদিন সেখানে ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক। তাঁদের ধর্মগুলো আলাদা হতে পারে , তবে অমৃতসরের এই স্বর্ণমন্দির ঘিরে তাঁদের আবেগ কোনও অংশে কম নয়।
সেই স্বর্ণমন্দির ঘিরেও এবার বিতর্কের মেঘ। সেখানে প্রতিদিনই বসে কীর্তনের আসর। ১৫ জন গায়ক প্রতিদিন অন্তত ৩১টি রাগ পরিবেশন করেন ২০ ঘণ্টা ধরে। শিখ ধর্মে ঈশ্বরবন্দনার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ধরা হয় এই কীর্তন ও গুরবানী পরিবেশনকে। সেই সঙ্গীতের নেপথ্যে এতদিন ব্যবহার করা হত হারমোনিয়াম-সহ আরও বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। তবে এবার সেখানে হারমোনিয়াম ব্যবহারেই আপত্তি জানাল হরমন্দির শাহিব তথা স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখত।
ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতে এলেও ধ্রূপদ সঙ্গীতের জগতে একটা বড় জায়গা দখল করে রয়েছে হারমোনিয়াম। আজও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয় একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই বাদ্যযন্ত্রটি। আর এবার সেই শতাব্দীপ্রাচীন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারেই আপত্তি জানাল অকাল তখতের জাঠেদার গিয়ানি হরপ্রীত সিংহ।
তাঁর দাবি, প্রাচীন তারবিশিষ্ট যন্ত্রানুসঙ্গই ভারতীয় সংস্কৃতির সম্পদ ও ঐতিহ্য। কীর্তনের সঙ্গেও সেসবই বাজার কথা আদতে। ব্রিটিশ আমলে ভারতে আসে হারমোনিয়াম নামে এই বাদ্যযন্ত্রটি। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে এই হারমোনিয়ামের কোনও সম্পর্কও নেই। তাই অবিলম্বে শিখ কীর্তনের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজানো বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে পদক্ষেপের জন্য শিরোমনি গুরুদ্বারা পরবন্ধন কমিটিকে ৩ বছরের সময়সীমাও বেঁধে দিয়ে অকাল তখত। এ নিয়ে একমত শিখগুরু গুরুনানকের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ভক্ত ভাই সাধারণের বংশধরেরাও। হারমোনিয়াম এ দেশের সংস্কৃতির অংশ নয় জানিয়ে তা কীর্তনে ব্যবহার বন্ধের পক্ষে সওয়াল করেছেন তাঁরাও।
আরও শুনুন: বেনজির শাস্তি প্রশাসনের! দলিত-মিছিলে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল ৪৮টি বাড়ি
ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। অকাল তখতের এই দাবির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন বহু বিদ্বজনই। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অলঙ্কার সিংয়ের মতে, ঐতিহ্যশালী তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্রগুলি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়াটা অবশ্যই জরুরি। তবে তার জন্য হারমোনিয়ামকে বাতিল করার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও গুরমত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ অলঙ্কার।
কীর্তনের জগতে একসময় বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল এই হারমোনিয়াম। আসলে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র শেখানোর মতো পন্ডিত ব্যক্তির অভাব দেখা যেতে শুরু করে এ দেশে। সেসময় আস্তে আস্তে কীর্তনের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ে হারমোনিয়াম। ১৯০১-০২ সাল নাগাদ প্রথম বার স্বর্ণমন্দিরের হারমোনিয়ামের সঙ্গে কীর্তন পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ব্রিটিশদের হাত ধরে বাদ্যযন্ত্রটি এ দেশে এলেও সেটিকে পরিমার্জন ও সংস্কার করেছিলেন বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রকার দ্বারকানাথ ঘোষ। তাঁর হাত ধরেই তৈরি হয়েছিল হারমোনিয়ামের একটি ভারতীয় সংস্করণ, যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়া অবর্জনীয় একটি উপকরণ। এ বার সেই হারমোনিয়ামকে সরাতেই উঠেপড়ে লেগেছে স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখত।