সুরের মাধ্যমে ঈশ্বরসাধনার কথা রয়েছে বহু ধর্মেই। আর শিল্প বা সুরের যে নিজস্ব কোনও ধর্ম হয় না, তা কে না জানে! কিন্তু সেই গান গেয়েই এবার মুসলিম ধর্মগুরুর রোষের মুখে পড়লেন এক সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর বিরুদ্ধে আনা হল গুরুতর অভিযোগও। ঠিক কী কী কারণে কাঠগড়ায় তোলা হল তাঁকে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সুর এমন এক মাধ্যম, যার সাহায্যে সরাসরি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়। অনেকটাই এমন মনে করেন। বহু ধর্মেই তাই সুরসাধনার কথা রয়েছে। বহু গুরুদ্বারেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন রকমের রাগ পরিবেশনের রেওয়াজ রয়েছে। আজ থেকে নয়, বহু বহু যুগ আগে থেকেই সুরসাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। আর সেই সুর বা সঙ্গীতের আলাদা কোনও ধর্ম হয় না।
সম্প্রতি এক গায়িকার গাওয়া এক শিবের ভজন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কানওয়ার যাত্রা-সহ বেশ কয়েকটি হিন্দু অনুষ্ঠানে বাজানো হয়েছিল সেই গান। আর তার জন্যই মুসলিম ধর্মগুরুদের রোষের মুখে পড়তে হল ফরমানি নাজ নামে মুজফফরনগরের ওই গায়িকাকে। এর আগে একটি জনপ্রিয় হিন্দি রিয়েলিটি শো-তে অংশ নিয়েছিলেন ফরমানি। সেখান থেকেই যথেষ্ট পরিচিত মুখ ফরমানি। প্রায়শই গান গেয়ে ইউটিউবে আপলোড করেন ওই শিল্পী। সম্প্রতি ‘হর হর শম্ভু’ নামে একটি শিবের ভজন দারুণ জনপ্রিয়তা পায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর সেখান থেকেই শুরু বিতর্কের।
আরও শুনুন: বুকারজয়ী উপন্যাসেও অসহিষ্ণুতার খাঁড়া, বাতিল গীতাঞ্জলি শ্রী-র সংবর্ধনার অনুষ্ঠান
এর আগে একাধিক বার নানাবিধ ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ছবি আমরা দেখেছি দেশ জুড়ে। লাউডস্পিকার বিতর্ক থেকে শুরু করে হজরত মহম্মদকে নিয়ে নূপুর শর্মার আপত্তিকর মন্তব্য, এমনকী কালী তথ্যচিত্রের পোস্টারকে কেন্দ্র করেও বিতর্কে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। সম্প্রতি বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলি শ্রী-র বিরুদ্ধেও হিন্দু দেবদেবীকে নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করার অভিযোগ উঠেছে। শিল্প থেকে সংস্কৃতি, একের পর এক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ছবি কার্যত প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ভারতের বহুত্ব নিয়েই। এর মধ্যে নয়া বিতর্ক বাড়াল ফরমানির গান নিয়ে মুসলিম ইমামের মন্তব্য।
উত্তরপ্রদেশের সাহরনপুরের দেওবন্দ এলাকার ইমাম মৌলনা ইশাক গোরা সম্প্রতি জানান, মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মের ভজন গাওয়াটা শরিয়তবিরোধী। একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মৌলনা বলেন, “স্বাধীন দেশে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে নিজস্ব মত প্রকাশের। ফরমানি যা ইচ্ছা গাইতেই পারেন, তাঁকে কেউ আটকাচ্ছে না। এমনকী তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা হচ্ছে তেমনটাও নয়। তবে আমাদের ধর্ম অন্য ধর্মের ভজন গাওয়ার অনুমতি দেয় না।”
মৌলনার সুরেই সুর মিলিয়েছেন দেওবন্দের আর এক ইসলাম ধর্মগুরু। মুফতি আসাদ কাসমি নামে ওই ব্যক্তির মতে, “এ ধরনের কাজ ইসলাম ধর্ম অনুসারে পাপ। যে কোনও মুসলিমের উচিত এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা। আল্লাতালার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত ফারমানির।” এমনকী গান বা নাচের মত শিল্প ইসলাম-বিরোধী বলেও তোপ দেগেছেন তাঁরা।
আরও শুনুন: শ্লোকে ‘ভেজাল আমদানি’ করেই সতীদাহ! শাস্ত্রের পথেই প্রতিরোধ করেছিলেন রামমোহন
সমালোচনা ও নিন্দার মুখে গুটিয়ে না গিয়ে বরং রুখে দাঁড়িয়েছেন গায়িকা। তাঁর কথায়, মহম্মদ রফির মতো বিরাট মাপের গায়কও অজস্র ভক্তিমূলক গান এবং ভজন গেয়েছেন। ফরমানি উল্লেখ করেছেন মাস্টার সালিম নামে আর এক গায়কের কথাও। যিনি ভক্তিমূলক গান গেয়ে ইতিমধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বেশ কয়েকটি বলিউড সিনেমাতেও গান গেয়েছেন সেলিম। ফারমানির সাফ কথা, তিনি শিল্পী, এবং শিল্পের কোনও ধর্ম হয় না। কোনও শিল্পীই হিন্দু বা মুসলিম দর্শক দেখে তাঁর অনুষ্ঠান করেন না। গান গাওয়া তাঁর পেশা। আর যে কোনও বিরোধিতার মুখেই তিনি মাথা নত করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন তরুণ ওই গায়িকা।