‘আতঙ্ক’ ছবিতে মাস্টারমশাইকে দেখতে না-বলার হুমকির সঙ্গে নারী নিগ্রহের প্রসঙ্গটি জুড়ে ছিল। বাস্তবে, নারী নিগ্রহের অনুষঙ্গেই এই দেখতে না-পাওয়ার হুমকি কাটিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন মাস্টারমশাইরা। যে সময় নিজেই প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার শিখছে, সেই সময়ে শিক্ষকের এই ভূমিকা যে জরুরি তা বলাই বাহুল্য।
মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি! ‘আতঙ্ক’-এর ভাষা বোধহয় এমনটাই। তপন সিংহের দৌলতে বাঙালি সে-কথা ভালোই জানে। তবে, মাস্টারমশাইরা কি সত্যিই কিছু দেখেন না! সাম্প্রতিক ক্ষুব্ধ সময় অবশ্য বলছে, তাঁরা সবই দেখেন। প্রয়োজনে দেখতেও বলেন।
আরও শুনুন:
দল বা কোন্দল নয়, ভয় না পাওয়াই রাজনৈতিক
নতুন করে এ-কথা আমাদের ভাবতে বাধ্য করছেন একজন শিক্ষিকা। যিনি স্কুলের ভিতরে দাঁড়িয়েই ছাত্রীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের অধিকারের পক্ষে সরব হওয়ার জন্যই আসলে যে কোনও নির্যাতিত মানুষের অধিকারের পক্ষে গলা তোলা জরুরি। বলেছেন, “নিজেদের অধিকারের জন্য অন্য যে কোনও ভিক্টিমের পাশে দাঁড়াও। না হলে তুমি তোমার অধিকার কোনও দিনও খুঁজে পাবে না।” যাদের উদ্দেশে তিনি এ-কথা বলছেন, যারা নিজে থেকেই তাঁর কাছে এসে নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়েছিল, দেশের আইন মতে তারা এখনও সাবালিকা নয়। যে আঠেরো বছর বয়স বাধা জানে না, সেই আঠেরোতেও পৌঁছয়নি তারা। কিন্তু তা বলে আশেপাশে যা কিছু ঘটছে, তা তারা তাদের মতো করে দেখবে না, বুঝবে না- এমনটা তো নয়। আর সেই দেখাকেই গুরুত্ব এবং স্বীকৃতি দিয়েছেন এই শিক্ষিকা। কারণ নিজের দেখাকেও কোনও চাপ বা প্রতাপের কাছে হারিয়ে ফেলতে রাজি নন তিনি। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, সরকারি চাকরি করার দরুন তাঁদের অনেকসময় অনেকরকম বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু তা বলে মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেওয়া চলে না। তাই ঘরে বসে থাকা নয়, রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষিকা মোনালিসা মাইতির এই কথায় আলোড়ন পড়েছে বঙ্গসমাজে।
সেই সঙ্গে ফিকে হয়ে গিয়েছে আতঙ্কের সেই পুরনো বয়ান। মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি বললেই, মাস্টারমশাইরা তা মানবেন কেন! সেদিনও মানেননি, আজও নয়।
বাঙালির মনে আছে, ‘আতঙ্ক’ ছবিতে এই দেখতে না-পাওয়ার হুমকি কেমন বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল প্রবীণ শিক্ষকের জীবনে। সেই ভূমিকায় যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন, তিনিই আবার অভিনয় করেছিলেন আরও এক পণ্ডিতমশাইয়ের ভূমিকায়। সেই উদয়ন পণ্ডিত শাসকের শত হুমকি সত্ত্বেও তার অনাচার দেখতেন, সেই অনাচারের বিরুদ্ধে স্বর জারি রাখতেন, এমনকি তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতেন সেই প্রশ্নের সুর। সেই পণ্ডিতমশাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শেখা আর শেখানো বন্ধ ঘরের কাজ নয় কেবল। বাইরে যে চারপাশটা বল্গা হারিয়ে দিশেহারা ছুটছে, তাকে দেখা আর যুক্তি দিয়ে সেই চলাকে বিচার করতে শেখানোও শিক্ষকের কাজ। অর্থাৎ শুধুমাত্র পুথিপড়া বিদ্যা নয়, সমাজ আর সময়ের সঙ্গে পড়ুয়াদের জুড়ে দেবেন তিনি। শিক্ষকের কাজ নতুন প্রশ্নের দিকে তরতাজা মনগুলিকে এগিয়ে দেওয়া, যাতে সংকটের আয়োজনেও তারা প্রশ্ন করতে জানে। একজন একক মানুষ হিসেবে কোনও খুদেরও যে নিজস্ব মতামত রয়েছে, তা আমরা মানতেই শিখিনি। তাই স্কুলপড়ুয়াদের ন্যায়বিচারের দাবি তুলতে দেখলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখলে আমাদের এতদিনের চেনা ছকে ধাক্কা লাগে। এই শিক্ষিকা কিন্তু সে পথে হাঁটেননি। উলটে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, যদি রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে তাহলে ১৮-এর নিচের মানুষটাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও শুনুন:
কাঁদছেন মা দুর্গা, তবু বধ তিন অসুরকে… খুদে শিল্পীর ভাবনা ভাবাচ্ছে সময়কে
‘আতঙ্ক’ ছবিতে মাস্টারমশাইকে দেখতে না-বলার হুমকির সঙ্গে নারী নিগ্রহের প্রসঙ্গটি জুড়ে ছিল। বাস্তবে, নারী নিগ্রহের অনুষঙ্গেই এই দেখতে না-পাওয়ার হুমকি কাটিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন মাস্টারমশাইরা। যে সময় নিজেই প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার শিখছে, সেই সময়ে শিক্ষকের এই ভূমিকা যে জরুরি তা বলাই বাহুল্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মানুষ তাই এই শিক্ষিকাকে প্রণাম জানিয়েছেন। আসলে ক্ষুব্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে সকলে ঠিক কথাটি স্পষ্ট করে বলে উঠতে পারেন না। তিনি পেরেছেন। আর যিনি পেরেছেন তিনিই তো সময়ের সত্যিকার শিক্ষক।