আর জি করে কাণ্ডের মীমাংসা করতে পলিগ্রাফ টেস্টের পথে হাঁটছে সিবিআই। অভিযুক্তরা মিথ্যে বলছে কি না, তা বুঝতেই এই পরীক্ষা করা হয়। তবে সেই পরীক্ষাতেও কি মিথ্যে বলা সম্ভব? কীভাবে কাজ করে পলিগ্রাফ টেস্ট? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
আর জি মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় ধৃত সঞ্জয় রায়ের পলিগ্রাফ টেস্টের অনুমতি মিলেছিল আগেই। পরে কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, সেদিন রাতে নির্যাতিতার সঙ্গে থাকা চার চিকিৎসক পড়ুয়া, সঞ্জয়ের বন্ধু আরও এক সিভিক ভলান্টিয়ারেরও পলিগ্রাফ টেস্ট চায় সিবিআই। কেন্দ্রীয় ফরেনসিক পরীক্ষাগারে লাই ডিটেক্টর যন্ত্রের সামনে বসিয়ে এই পরীক্ষা করা হবে। ‘লাই ডিটেক্টর’, এই নামেই ইঙ্গিত রয়েছে যে এই যন্ত্রের কাজ মিথ্যাকে চিহ্নিত করা। সত্যিই কি তেমনটা ঘটে? কীভাবে মিথ্যাকে চিহ্নিত করে এ যন্ত্র? নাকি এই পরীক্ষাতেও মিথ্যে বলা অসম্ভব নয়?
আরও শুনুন:
ধর্ষণ-কাণ্ডে উঠছে বিচারের দাবি, অন্যদিকে পর্ন সাইটে তুঙ্গে ধর্ষিতার খোঁজ
আগে পুলিশি হেফাজত কিংবা জেল হেফাজতে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ অর্থাৎ মারধর করার চল ছিল ভালরকম। বর্তমানে মানবাধিকার কমিশনের দরুন সবসময় ইচ্ছেমতো সে কাজ করা যায় না বলেই দাবি পুলিশের। সে কারণেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নানাভাবে তথ্য বার করার চেষ্টা করা হয়। যার অন্যতম পলিগ্রাফ টেস্ট। যে তথ্য প্রমাণিত হলে বেকায়দায় পড়তে হবেই, সেখানেই মানুষের মস্তিষ্ক মিথ্যে বলার সংকেত পাঠায়। উত্তর দেওয়ার সময় শরীর বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, যা একটি গ্রাফের মাধ্যমে যন্ত্রে ফুটে ওঠে। আর সেই প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেই এই পরীক্ষা বুঝতে চায়, মানুষটি মিথ্যে বলছে কি না। পলিগ্রাফ কথার মানে হচ্ছে মাল্টিপল গ্রাফ প্লট করে অ্যাবনর্মালিটি বা অস্বাভাবিকতাকে চিহ্নিত করা। স্নায়ু ও পেশির নানারকম সঞ্চালন, রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের বাড়া-কমা, শ্বাস দ্রুত হওয়া, এমন নানা শারীরবৃত্তীয় বদল থেকে অস্বাভাবিকতা চিনতে চায় লাই ডিটেক্টর। ঘাড়, মুখ, চোখ, নাক, হাত, পা সর্বত্র লাই ডিটেক্টরের রাডার বসানো হয়; যাতে সামান্যতম বিচলনও ধরা পড়ে।
কেবলমাত্র হ্যাঁ কিংবা না-তেই উত্তর দিতে হয় লাই ডিটেক্টরকে। যন্ত্র সেট করার পর মানুষটিকে কিছু প্রশ্ন করা হয়, যেখানে তার সত্যি কিংবা মিথ্যে বলার সুযোগ রয়েছে। শুরুটা হয় এমন প্রশ্ন দিয়ে, যেসবের উত্তর জানা। মানুষটির নিজের নাম, বাবার নাম, পেশা, এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়। আবার সে মিথ্যেই বলবে, এমন কিছু প্রশ্নও করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। যাতে মানুষটির সত্যি ও মিথ্যে বলার প্যাটার্ন যন্ত্রের কাছে খানিক স্পষ্ট হয়। এই প্রাথমিক প্যাটার্নের উপর ভিত্তি করেই যন্ত্র দ্যাখে, জরুরি প্রশ্নের উত্তরে গ্রাফের প্যাটার্ন কোনদিকে যাচ্ছে। এক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্তা যেমন উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কোনও অপরাধী কী অস্ত্র দিয়ে খুন করেছে তা জানা যাচ্ছে না। প্রশ্নকর্তা কয়েকটা অস্ত্রের নাম তার সামনে বললেন। ঘাতক সব অস্ত্রের নাম শুনেই অস্বীকার করবে হয়তো। তবে অন্য অস্ত্রের নাম শুনে তার উত্তর, আর তার নির্দিষ্ট মারণাস্ত্রের নাম শুনে দেওয়া উত্তর, দুয়ের ক্ষেত্রে তার শরীর আলাদা প্রতিক্রিয়া দেবে। সেখান থেকেই অস্ত্রটিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
আরও শুনুন:
কাঁদছেন মা দুর্গা, তবু বধ তিন অসুরকে… খুদে শিল্পীর ভাবনা ভাবাচ্ছে সময়কে
তবে সমস্যা হল, মানুষ মিথ্যে বললেই যে তার শরীর কোনও না কোনও ভাবে উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া দেবে, এমনটা নাও হতে পারে। আর সেটা না ঘটলেই লাই ডিটেক্টর অসহায়। কমপালসিভ লায়ার, সাইকোপ্যাথ, এদের ক্ষেত্রে পলিগ্রাফে আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে না। প্যাথলজিক্যাল লায়ারেরা সাময়িকভাবে মিথ্যেকেই সত্যি বলে ভেবে নেয়, ফলে সেখানে মিথ্যে বলার প্রতিক্রিয়া তার শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াতেও ধরা না পড়তে পারে। মনে করা হয়, শতকরা ৯৫টি ঘটনায় পলিগ্রাফ টেস্ট মিথ্যে বলার চেষ্টাকে ঠিক ঠিক চিনতে পারে। কিন্তু বাকি ৫ শতাংশ ঘটনার মধ্যে থেকে যায় এই শ্রেণির মানুষেরা।
আর এই সব কিছু মাথায় রেখেই পলিগ্রাফ টেস্টের রিপোর্ট আইনের চোখেও কনক্লুসিভ নয়, অর্থাৎ চূড়ান্ত সত্য নয়। তবে তদন্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তা খানিকটা কাজে আসবে, আপাতত এ আশাই করা যাক।