শোক প্রকাশের ভাষা এক একজনের কাছে এক এক রকম। তা কেউই নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন না। তবু, নেটদুনিয়ায় নানা মতামতের ছড়াছড়ি। এমনকী সেই মতের তির ঘিয়ে বিঁধল সদ্য বাবাকে হারানো মেয়েকেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় কি তবে দিনে দিনে নীতিপুলিশির মাত্রা বাড়ছে?
শোক কখনও বলে কয়ে আসে না। পহেলগাঁওয়ের (Pahalgam Terror Attack) ঘটনাই যেন তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। রোজকার শান্তিপূর্ণ জীবনের মধ্যে একচুল ফাঁক পেলেই, হুড়মুড় করে ঢুকে আসে বাঁধভাঙা জলের মতো। আর সব এলোমেলো করে দিয়ে যায়। তবে শোকের আচমকা হানায় আক্রান্ত ব্যক্তিটির বহিঃপ্রকাশ কেমন হবে, তা বোধহয় আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় না। অনেকেই সেই পাহাড়-প্রমাণ ঢেউয়ের ধাক্কায় খড়কুটোর মতো ভেসে যায়, চেয়েও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাতেগোনা কয়েকজন থেকে যায় এরই মাঝে, যারা অমানুষিক যন্ত্রণা সইতে গিয়ে পাথরের মতো অসাড় হয়ে যায়। বাইরে থেকে দেখে, তাদের বুকের ভিতর ঘটে চলা উথালপাথালের কিছুমাত্র আভাস পাওয়া যায় না। হয়তো বেশিরভাগের প্রতিক্রিয়া একই রকম হয় বলে অন্যদের অদ্ভুত লাগতে পারে সাধারণ চোখে। তবে এই ব্যতিক্রমীদের দলে না থাকলে, কেবল দূর থেকে বিচার করে কোনও তকমায় দাগিয়ে দেওয়া, নেহাতই অর্থহীন।
কেরলের বাসিন্দা এন রামাচন্দ্রন তাঁর পরিবারের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন কাশ্মীর। পেহেলগাঁও-এর পাইন বনে ঘেরা মনোরম বনপথ ধরে ট্রেক করার সময়, আচমকাই এক সন্ত্রাসবাদী পথ আটকায় তাঁদের (Pahalgam Terror Attack)। এবং ধর্মীয় পরিচয় জানবার পর মুহূর্তখানেকের ব্যবধানে গুলিবিদ্ধ করে এন রামাচন্দ্রনকে। যা হয়তো তিনি বা তাঁর পরিবারের কোনও সদস্য জীবনেও ভাবেননি, তেমনভাবে পালিত হয় রামাচন্দ্রনের শেষকৃত্য। চেনা-অচেনা মানুষদের বলয়ে আবিষ্ট হয়ে, ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনিতে বিদায় জানায় তাঁর পরিবার।
তাঁর কন্যা আর্তি মেনন, যিনি স্বচক্ষে বাবার নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন, দফায় দফায় সাক্ষাৎকার দেন নিউজ চ্যানেলগুলির কাছে। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যার মাঝেই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কাশ্মীরী ড্রাইভার মুসাফির ও সমীরকে। স্বাভাবিকভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি। আর আশ্চর্যভাবে দেখা যায়, তাতে নেতিবাচক মন্তব্যের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে বাকি দেশের মানুষ প্রায় একঘরে করতে বসেছেন কাশ্মীরের (Pahalgam Terror Attack) আপামর জনসাধারণকে। সে তালিকায় খেটে খাওয়া ঘোড়াচালক থেকে শুরু করে গরীব শালওয়ালা, ট্যুর গাইড, ট্যাক্সিচালক, হোটেল মালিক, কে নেই! যেন শ্রমজীবী মানুষগুলিকে বয়কট করলেই সন্ত্রাসীদের উপর মারণ আঘাত নেমে আসবে, এমনটা মত তাঁদের। সাম্প্রতিক ‘ট্রেন্ড’ অনুযায়ী, সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে ভালোমন্দ বিবেচনা না করেই নিন্দে করতে হবে কাশ্মিরীদের, এমন অলিখিত নিয়ম জারি হয়েছে।
আর তাই বাবাকে হারিয়েও কীভাবে কাশ্মীরি ‘ভাই’দের প্রশংসা করছেন আরতি, তা নিয়ে নানান বাঁকা মন্তব্যের তির ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে। কেউ বলছেন, সাক্ষাৎকারে আরতি এসেছেন রীতিমতো পরিষ্কার পরিপাটি পোশাক পরে, যা দেখে একেবারেই মনে হচ্ছে না যে তুমুল শোক (Pahalgam Terror Attack) ছায়া ফেলেছে তাঁর পরিবারের উপর। কেউ আবার বলছেন, সত্যি করে বাবার মৃত্যু চাক্ষুষ করলে, এতখানি ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে বক্তব্য রাখতে পারে না কেউ। মোট কথা, পর্যাপ্ত শোকের অভাব। ঠিক যতটা হলে সহজে সহানুভূতি দেখানো যেত এই পিতৃহারা মেয়েটির প্রতি, তাতে কিছু কম পড়ে যাচ্ছে! শোকের যাপন যদি চোখেই না পড়ে, তবে তা গণ্য করা যায় কেমনে!
‘শেরশাহ’ সিনেমায় বিক্রম বাত্রার চরিত্রটি বর্ডারে শত্রুদেশের গুলিতে প্রাণ হারান। তাঁর কফিনবন্দি দেহ পরিবারের কাছে নিয়ে আসা হলে, বাগদত্তা ডিম্পল কান্নায় ভেঙে পড়েন। কফিন ছুঁয়ে অপূর্ণ ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দেন শেষবারের মতো। সিনেমাটির অন্যান্য অংশের চাইতে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এই দৃশ্যটি। কারণ প্রিয়জনকে হারিয়ে এমনভাবেই তো কাঁদা উচিৎ! সিনেমার মতো! তাই তো, এই ‘পেহেলগাঁও টেরর অ্যাটাক’-এরই (Pahalgam Terror Attack)অন্য ‘ভিক্টিম’ নৌ-আধিকারিক বিনয় নারওয়ালের স্ত্রীকে স্বীকৃতি দিয়েছেন নেটনাগরিকেরা। কারণ স্বামীর কফিন আঁকড়ে তাঁর কান্নাটি অনেকখানি মিলে গিয়েছে সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে। যেমনটা হলে ঠিক কান্না-কান্না মনে হয়। যেমনটা পর্দায় দেখলে একই সঙ্গে বেদনা আর পরিতৃপ্তি অনুভব হয় দর্শকদের। বাস্তব আর পর্দার দৃশ্য দুটির ‘কোলাজ’-ও তাই রমরম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে।
সোশ্যাল মিডিয়া যেন এক নাটকের মঞ্চে উঠিয়ে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বকে। পারফর্মার-রাই আবার বসে পড়েছেন দর্কাশকাসনে, চুলচেরা বিচার চলছে প্রত্যেকের আচরণের। কারও কোনও কথা, কোনও ভঙ্গিমা ভালো না লাগলেই তাঁকে অকথ্য ভাষায় সমালোচনা করা চলে। মতের অমিল হলে মৃত্যুভয় দেখানো যায়। এখানে কারও প্রতিক্রিয়াকে বেঁধে দেওয়ার মতো কোনও মানদণ্ড রাখা হয়নি, ফলে ‘সবাই রাজা’! ব্যক্তিমানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে অনেকখানি ত্বরান্বিত হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা কি মানুষের ভিতরের নখ-দাঁত বের করা রূপটিকে এতটাই সাহস দেয় যে সে বাবার প্রতি মেয়ের ভালবাসার দিকেও আঙুল তুলতে পারে? এমন পৃথিবী কি সত্যিই ভবিষ্যতের শিশুর কাছে বাসযোগ্য থাকবে? প্রশ্ন রয়েই যায়।