যে ভয়াবহ হত্যালীলা সমগ্র দেশকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, যার রেশ ধরে ভারত-পাক সংঘর্ষ দ্রুত ত্বরান্বিত হল, সেখানেও কি অদ্ভুতভাবে অপরাধের ভাগীদার হতে হল নারীকে! সিনেমার নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ রাখা নিয়ে খানিক ঝামেলাঝাঁটি করেন সিনেমার প্রযোজকরা; কান উৎসবের রেড কার্পেটে ভারতীয় নায়িকাদের সিঁথিভর্তি সিঁদুর দেশপ্রেমেরই নজির কি-না, তা নিয়ে কতক জলঘোলা হয়। অথচ দেশে নারীর অবস্থানে তিলমাত্র পরিবর্তন আসে না।
যে সংঘাত দুই দেশের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষকে পথ দেখিয়েছে, তা-ও কী অবলীলায় এসে দাঁড়াল নারীবিদ্বেষের প্রসঙ্গে। দেশের মুখপাত্ররা শুরু থেকে বলে চললেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor) -এর কাণ্ডারি মেয়েরাই; দেশের মেয়েদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেই এর যাবতীয় কর্মসূচি। তবুও কোন এক আশ্চর্য ক্ষমতাবলে শাসকদলের ঘনিষ্ঠই পহেলগাঁও হামলায় মেয়েদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাও আবার সেই মেয়েরা, যাঁরা আকস্মিক সন্ত্রাসী হামলায় পরিবারের মানুষ খুইয়েছেন! হয়তো লিঙ্গগত পরিচয়ে পুরুষ হলেই, বাড়তি ক্ষমতার অধিকার পেয়ে যাওয়া যায় বলে মনে করেন একাংশের মানুষ।
এতসব কথা যাঁর বক্তব্য ঘিরে উঠে আসে, তিনি রামচন্দ্র জাংরা (Ram Chander Jangra), বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ। পহেলগাঁও হামলার পর পেরিয়ে গিয়েছে এক মাসেরও বেশি সময়, তবে আক্রমণকারী জঙ্গিদের একজনও ধরা পড়েনি এখনও পর্যন্ত। এরই মাঝে ঘটে গিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor)। আর তাই তা ঘিরে চর্চা এখনও তুঙ্গে। এরই মাঝে সাংসদ জাংরা বলে বসেন, পহেলগাঁও হামলার দিন মেয়েরা রুখে দাঁড়াতে পারেনি বলেই নাকি ২৬জন পর্যটককে প্রাণ হারাতে হয়েছে! বলা বাহুল্য, এই ২৬জনই পুরুষ। জোড়হাতে নতিস্বীকার করার বদলে সেই মহিলা পর্যটকেরা যদি লড়াই করতেন, তাহলে এমনটা হত না মনে করেছেন জাংরা। তিনি বলেন, স্ত্রীদের ইচ্ছেশক্তি আর সাহসের অভাব ছিল বলেই স্বামীদের মরতে হয়েছে তাঁদের চোখের সামনে। এ প্রসঙ্গে রানি লক্ষ্মীবাই, রানি অহল্যাবাই হোলকরের মতো বীরাঙ্গনার উদাহরণ টানেন তিনি। তাঁর মতে, মহিলাদের ‘অগ্নিবীর’ হওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকলে না-কি এমন দিন আসত না!
দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে হতবাক হওয়া ছাড়া বুঝি কিছুই করার থাকে না জনসাধারণের! যে ভয়াবহ হত্যালীলা সমগ্র দেশকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে তুলেছিল, যার রেশ ধরে ভারত-পাক সংঘর্ষ দ্রুত ত্বরান্বিত হয়, সেখানেও কি অদ্ভুতভাবে অপরাধের ভাগীদার হতে হল নারীকে! ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হামলার (Pahalgam Attack) দিন ধর্ম পরিচয়টুকু জেনে নিয়ে নির্বিচারে পুরুষ পর্যটকদের হত্যা করে সন্ত্রাসীরা, অপরদিকে এই হামলার কথা কেন্দ্রসরকারকে জানানোর দায়িত্ব দিয়ে, নারীদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখে। সেই মুহূর্তে সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে, ধর্মই একমাত্র পরিচয় ছিল। তবুও সন্ত্রাসীরা মেয়েদের ছেড়ে দিয়েছিল, হয়তো তারা লিঙ্গগত পরিচয়ে দুর্বল ভেবেই।
এরপরে কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রত্যাঘ্যাতের আয়োজন করলেন, মেয়েদের হারানো স্বজনের কথা মাথায় রেখে তার নামই দেওয়া হল ‘অপারেশন সিঁদুর’। এমনকি সমগ্র কর্মকাণ্ডটিতে মেয়েরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করলেন। কিন্তু তারপরেও সত্যি কিছুই বদলে যায় কি? সিনেমার নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ (Operation Sindoor) রাখা নিয়ে খানিক ঝামেলাঝাঁটি করেন সিনেমার প্রযোজকরা; কান উৎসবের রেড কার্পেটে ভারতীয় নায়িকাদের সিঁথিভর্তি সিঁদুর দেশপ্রেমেরই নজির কি-না, তা নিয়ে কতক জলঘোলা হয়। অথচ দেশে নারীর অবস্থানে তিলমাত্র পরিবর্তন আসে না।
নিরবচ্ছিন্ন নারীবিদ্বেষের সামনে বুঝি ব্যাকসিটে যেতে হয় বহুযুগ ধরে চলে আসা হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও। যে বিশ্বাসে পরিবারে নতুন আসা বধূর শুচিতার সঙ্গে স্বামীর স্বাস্থ্যের সমীকরণ এঁকে দেয় ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, সে বিশ্বাসই ছায়া ফেলে বিজেপি সাংসদের বক্তব্যেও। ভয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলা মেয়েরা যে কোন উপায়ে স্বামীর রক্ষাকর্তা হতেন, সেসব যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন না-হয় তোলাই রইল। জনসমক্ষে করা এক সাংসদের মন্তব্য ঘিরে তবু জিজ্ঞাস্য থেকে যায়, এই ঘটনায়, বা এ ধরণের অন্য কোনও ঘটনাতে স্ত্রী প্রাণ হারালেও কি পুরুষের করনীয় উচিৎ-অনুচিত নির্ধারণ করতে বসত সমাজ? নিরাপত্তা-প্রত্যাশী নারীদের কি ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠা ছাড়া অন্য কোনও বাঁচার উপায় নেই?