বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য ভারতের সাধনা, তা যেন ছড়িয়ে আছে এইরকম লোকায়ত চিহ্নগুলোতেই। শৈব সংস্কৃতির সঙ্গে লোকায়তের যোগ নিবিড়। কৃষিসভ্যতার সঙ্গে শিবের যোগাযোগ। সভ্যতার এই যে গোড়ার সম্পর্ক, তাই-ই যেন প্রবহমান হয়ে আছে উপাসনার এই সম্মিলনে।
হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? এর উত্তর হতে পারে, একটাই। ওরা সকলেই মহাদেবের ভক্ত। অসমের পাঁচশো বছরের প্রাচীন এক শিব মন্দির যেন শাশ্বত ভারতবর্ষের চিরন্তন রূপটিকেই জাগিয়ে রেখেছে।
অসমের গৌহাটির কাছেই রংমহল গ্রাম। সেখানেই দেখা মিলবে এই ৫০০ বছরের প্রাচীন শিব মন্দিরের। তবে, উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে একটি মুসলিম পরিবার। সম্প্রদায়গত ভাবে অন্য বিশ্বাসের শরিক হলেও, শিবের উপাসনা এই পরিবারের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ফলত বংশ পরম্পরায় চলছে এই রেওয়াজ। প্রাচীন এক বটবৃক্ষের নিচে স্থাপিত এই শিবলিঙ্গ। পরনে লাল কাপড়। আছে ত্রিশূল। ঠিক বাংলার লোকায়ত শিব মন্দির যেমন হয়, তেমনই। আর সেখানেই ভক্তিভরে মহাদেব-উপাসনা করেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পরিবারের পক্ষ থেকে মতিবর রহমান সংবাদসংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছিলেন, আদিদেবের সামনে কোনও ভেদাভেদ নেই। তাঁরা কয়েকশো বছর ধরেই এই মন্দিরের সেবা করে আসছেন। তাতে কেউ কখনও আপত্তি জানাননি। কারণ, এই প্রথা স্বীকৃত হয়ে আঞ্চলিক ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে। আর তিনি যে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী, তাতে শৈব উপাসনাতেও কোনও সমস্যা হয়নি। বরং তিনি বলছেন, এই প্রাচীন শিবলিঙ্গ যেন তাঁর পরিবারেরই একজন। পরিবারের যেমন ‘নানা’ থাকেন, শিবলিঙ্গ তাঁর কাছে সেরকমই সম্পর্কের আলো বয়ে আনে। আর শুধু তিনি বা তাঁর পরিবারের লোকেরাই নন, শিবের সামনে আসেন দুই সম্প্রদায়ের অন্যান্য অনেক মানুষ। কেউ পুজো করেন। কেউ দোয়া করেন। পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই এই শিবলিঙ্গ ভারি আপনার। এর প্রতি একটি নিজস্ব বিশ্বাস আছে, যা প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে।
ভারতবর্ষ ধর্ম-মতামতে বহু বিশ্বাসের দেশ। প্রতি বিশ্বাসেরই নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন আছে। তা সত্ত্বেও যে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক পরিসর, সেখানে সকলেই যেন এক হয়ে মিলতে পারেন। বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য ভারতের সাধনা, তা যেন ছড়িয়ে আছে এইরকম লোকায়ত চিহ্নগুলোতেই। শৈব সংস্কৃতির সঙ্গে লোকায়তের যোগ নিবিড়। কৃষিসভ্যতার সঙ্গে শিবের যোগাযোগ। সভ্যতার এই যে গোড়ার সম্পর্ক, তাই-ই যেন প্রবহমান হয়ে আছে উপাসনার এই সম্মিলনে। সেখানে সম্প্রদায় বা পৃথক ধর্মবিশ্বাস প্রাচীর তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক কারণে ধর্মবিশ্বাসে ঠোকাঠুকি লেগে যায় প্রায়শ। তবে, তার বিপ্রতীপে জেগে থাকে আর এক ভারতবর্ষ। সম্প্রদায় পেরিয়েও সেখানে চির জাগরূক হয়ে থাকে মানুষ আর মানবতা। পাঁচশো বছরের প্রাচীন এই শিবমন্দির যেন সেই মানবতার সাধনারই হদিশ দেয় ভারতবাসীকে।