এ দেশটা বরাবরই ছিল নানা ভাষা নানা মতের। তবু তার মধ্যেই বারবার মাথাচারা দিয়েছে অশান্তি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি। সাম্প্রতিক অতীতেও বারবার ঘনিয়েছে বিদ্বেষের সেই কুয়াশা। অথচ এ সবের ভিতরেই রয়ে গিয়েছে অন্য এক ভারতবর্ষ, যেখানে আজও ‘একই বৃন্তে’ ফোটে ‘দুটি কুসুম’। যেখানে হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় পা মেলান মুসলিম প্রতিবেশীরা। ফুল ছড়িয়ে জানান স্বাগত। আসুন, শুনে নিই, সেই ভারতবর্ষের গল্প।
ইদানীং কান পাতলেই সাম্প্রদায়িক হিংসার খবর ঘোরে হাওয়ায়। এর বিশ্বাসে আঘাত করে অন্য দল। তাদের রীতিরেওয়াজ নিয়ে আপত্তি ছুড়ে দেয় অন্য কেউ। সব মিলিয়ে চারদিকে যেন অসহিষ্ণুতার তাপ। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়ে ফায়দা খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। তবে আশার কথা সেই বিদ্বেষের বিষ বোধহয় এখনও গোটা ভারতের মানচিত্রটাকে ঘিরে ফেলতে পারেনি। এখনও কোথাও কোথাও কান পাতলে শোনা যায় মিলনের সেই চেনা পরিচিত সুর। যা-ই আসলে চিরকালের ভারতবর্ষ। যেখানে হিন্দুদের অনুষ্ঠানে পা মিলিয়েছে মুসলিম ভাই, আবার ইদের আনন্দে পিছিয়ে থাকেনি হিন্দু প্রতিবেশী পরিবারটি। আর সেই চেনা ছন্দই দেখা গেল ভোপালের চারবাত্তি এলাকার একটি অনুষ্ঠানে।
আরও শুনুন: কোরান পাঠ করেই শুরু হয় পূজা, সম্প্রীতির ধারা বয়ে নিয়ে চলেছে কর্ণাটকের মন্দির
এ যেন সেই চির পরিচিত দেশ। যেখানে হিন্দুদের হনুমান শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানে সানন্দে পা মেলালেন এলাকার মুসলিম ভাইয়েরা। ঝরে পড়ল পুষ্পবৃষ্টি। সমস্ত বিভেদের সুরকে ফিকে করে ধরা পড়ল একটুকরো অন্য ভারতবর্ষ।
রামনবমীকে কেন্দ্র করে ভোপালেরই কিছু কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল হিংসা। খারগোনে ও বড়ওয়ানি এলাকায় বেশ কয়েক জন আহত হন বলেও খবর। তার পর থেকেই বেড়েছে কড়াকড়ি। সেই আবহে হনুমান শোভাযাত্রা! স্বাভাবিক ভাবে প্রশাসনের তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। সেই ভয় সঙ্গে নিয়েই শনিবার ভোপালের বহু জায়গাতেই বেরিয়েছিল এই বিশেষ শোভাযাত্রা। মুসলিম পাড়া দিয়ে শোভাযাত্রা গেলে ফের অশান্তির আবহ তৈরি হতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল বিভিন্ন জায়গা। নানা স্তরের পুলিশি নিরাপত্তা তো ছিলই, তার সঙ্গে ড্রোন ক্যামেরা দিয়েও পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছিল। বহু উত্তেজনাপ্রবণ জায়গাতেই শোভাযাত্রায় আপত্তি জানিয়েছিল পুলিশ।
ভোপালের চারবাত্তি এলাকাটি মোটের উপর মুসলিমপ্রধান এলাকা। সেখান দিয়ে হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা যাওয়া নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের একটু কিন্তু কিন্তু তো ছিলই। তবে চারবাত্তিতে যখন ওই শোভাযাত্রা পৌঁছল, তখন যা ঘটল তাতে মুখে কথা সরল না নিরাপত্তাকর্মীদের। এলাকায় ঢুকতে না ঢুকতেই বিভিন্ন বাড়ির বারান্দা থেকে ঝরে পড়ল ফুল। সরু গলি, তখন মানুষে ছয়লাপ। তার মধ্যে কে হিন্দু, কে মুসলিম- দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সকলের গলায় তখন হনুমান বন্দনার মন্ত্র।
ততক্ষনে মিছিলে পা মিলিয়েছেন বহু মুসলিম ভাই। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন জুবের খান নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও পা মিলিয়েছিলেন শোভাযাত্রায়। জানালেন, “ভোপাল বরাবরই ভাতৃত্ব আর সম্প্রীতির জন্য পরিচিত। সেই সুর কাটতে দেব না কিছুতেই।” সাজিদ খান নামে এক স্থানীয়র গলাতেও শোনা গেল একই সুর। জানালেন, বহু বছর ধরেই ভোপালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছেন হিন্দু ও মুসলিমেরা, একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই এই উদ্যোগ বলে জানান তিনি।
আরও শুনুন: মন্দির চত্বরেই আয়োজন ইফতারের, মুসলমান পড়শিদের আমন্ত্রণ স্বয়ং পুরোহিতের
ওই ঘটনার ভিডিয়ো ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশ জুড়ে যখন অশান্তি আর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবাষ্প, সেখানে ভোপালের চারবাত্তি এলাকার এই ছবি যেন এক দমকা টাটকা বাতাস। এমনটাই মনে করছেন নেটিজেনরা। আসলে এ দেশ তো বরাবরই মৈত্রীরই দেশ। মিলেমিশে থাকার দেশ। আর সেই কথাই আরও একবার মনে করিয়ে দিয়েছে চারবাত্তি।