‘মাইক্রোসফট এআই’-এর সিইও মুস্তাফা সুলেইমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছিলেন। আচমকা শ্রোতাদের ভিড়ের মধ্যে থেকে শোনা গেল নারীকণ্ঠের ‘ধিক্কার’ ধ্বনি। “এ সংস্থার প্রতিটি মানুষের হাতে আমার দেশের রক্ত লেগে আছে!” চিৎকার করে বললেন সংস্থারই কর্মচারী ইবতিহাল আবৌসাদ, সেই সঙ্গে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দেন একটি ‘কেফিয়ে স্কার্ফ’। কী ঘটল এরপর?
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? ইজরায়েলি আক্রমণে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে প্যালেস্তানীয় হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক, শিশু, নারী, বৃদ্ধ। আকাশচুম্বী অট্টালিকা, আবাসন মুহূর্তে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে পড়ছে খেলনা বাড়িঘরের মতো। নেটদুনিয়ায় ‘ভাইরাল’ হওয়া প্রতিটি ভিডিও জানাচ্ছে, প্যালেস্তাইনের রং পাকাপাকিভাবে ধূসর হয়ে গিয়েছে। এই সময় বাকি পৃথিবীর সকলের পক্ষে কি চুপ থাকা সম্ভব, নাকি উচিৎ? মানবিকতা যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে বোধহয় চুপ করে থাকা আদতে আধিপত্যের হাত-ই শক্ত করা। আর তাই, প্রতিবাদ ঘনিয়ে উঠছে। সে প্রতিবাদ হতে পারে ব্যক্তিগত স্তরেও। সেই নমুনাই রাখলেন জনৈক মাইক্রোসফট কর্মী।
গত ৫ এপ্রিলের ঘটনা। মাইক্রোসফটের অফিসে গুরুগম্ভীর সভা চলছিল। ‘মাইক্রোসফট এআই’-এর সিইও মুস্তাফা সুলেইমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছিলেন। উপস্থিত ছিলেন কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস্, প্রাক্তন সিইও স্টিভ বামার সহ বহু মান্যগণ্য ব্যক্তিত্ব। মুস্তাফা সে সময়ে ব্যখ্যা করছিলেন কোম্পানির এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোডাক্ট ‘কোপাইলট’ সম্পর্কে, দর্শক-শ্রোতাদের জানাচ্ছিলেন সেটির বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
আচমকা শ্রোতাদের ভিড়ের মধ্যে থেকে শোনা গেল নারীকণ্ঠের ‘ধিক্কার’ ধ্বনি। মুস্তাফার বক্তব্য মাঝপথে থেমে গেল। সকলে অবাক হয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, সংস্থারই কর্মচারী ইবতিহাল আবৌসাদ-কে। ইবতিহাল কেবল আওয়াজ তুলে থেমে যাননি। দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যান মঞ্চের একেবারে কাছে। আর বলতে থাকেন, “আপনারা দাবি করছেন যে এআই-এর ব্যবহার কেবল হিতের জন্য হবে। কিন্তু এ কথা তো মিথ্যে! ইজরায়েলি মিলিটারিদের এআই-চালিত অস্ত্র বিক্রি করেছে আপনাদের কোম্পানি। পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা গেছে আমাদের দেশে, যাতে মদত দিয়েছেন আপনারা! এ সংস্থার প্রতিটি মানুষের হাতে আমার দেশের রক্ত লেগে আছে!” চিৎকার করে বলতে থাকেন ইবতিহাল, সেই সঙ্গে মঞ্চের দিকে ছুড়ে দেন একটি ‘কেফিয়ে স্কার্ফ’। কেফিয়ে – এককালে ছিল আরব বেদুইনদের অঙ্গসজ্জার অংশ; বর্তমানে ব্যাপক আকার ধারণ করা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতে যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্যালেস্তিনি সংগ্রামের প্রতীক। ততক্ষণে রক্ষীরা এসে ঘিরে ধরেছে ইবতিহালকে। একপ্রকার ঘাড়-ধাক্কা দিয়েই তাঁকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় সভাঘর থেকে। অন্যদিকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বক্তব্যে ফেরেন মুস্তাফা। তখনও তিনি জানেন না যে একই দিনে আবারও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশ আরও জমজমাট। মঞ্চে এসে বসেছেন বিল গেটস, বামার ও কোম্পানির বর্তমান সিইও সত্য নাদেলা। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম একসঙ্গে মাইক্রোসফটের সিইও পদে থাকা তিন ব্যক্তিত্ব এক মঞ্চ ভাগ করে নিচ্ছেন – এমন ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়ার দাবি রাখে। অথচ বিপত্তি ঘটল এখানেও। কোম্পানিরই অন্য আর এক কর্মচারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভানিয়া অগ্রওয়াল উঠে দাঁড়ালেন ও সোচ্চার হলেন আহত-মৃত প্যালেস্তানীয় বাসিন্দাদের জন্য। সংস্থার কাছে এমন ঘটনা একেবারে নতুন নয়। মাস দুই আগেও একটি অধিবেশন চলাকালীন কয়েকজন কর্মচারী যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ফলত জুটেছিল তাৎক্ষণিক বহিষ্কার। তবে তাতে প্রতিবাদ তো থেমেই থাকেনি, বরং বহুজাতিক সংস্থার কর্মীদের প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়েই।
এ-প্রতিবাদ গোটা সংস্থার নয়। সংস্থার কর্মীদের। অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্তরেই। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতিতে তা একেবারে অন্য তাৎপর্য নিয়েই হাজির হয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এই মুহূর্তে আধিপত্যকামী শক্তির দাপট। রাজনৈতিক কারণ নিশ্চিত আছে। তবে, রাজনৈতিক পরিধি পেরিয়েও যা থেকে যায়, তা হল মানবিকতার প্রসঙ্গ। বিশ্বের যেখানেই মানবতা বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত হয়, মানুষ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হন। সে প্রতিবাদ অবশ্য সবসময় যে হয়ে-ওঠে তা নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ এসে প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বাধ্যবাধকতার জায়গা এসে মানুষের মানবিক কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেয়। তবু, শেষ পর্যন্ত মানুষের পক্ষে থাকে মানুষই। এই দুই কর্মীর ব্যক্তিগত প্রতিবাদ হয়তো মানুষনিধন যজ্ঞ থামাতে পারবে না। কিন্তু অগণিত মানুষকে সাহস আর শক্তি দেবে আধিপত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ক্ষেত্রে। হয়তো এই প্রতিবাদের কারণে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিও স্বীকার করতে হবে। তবে, এখানেই যেন জেগে ওঠে সেই শাশ্বত কথা- সবার উপরে মানুষ সত্য।
আর তাই প্রতিবাদ, তা যদি ব্যক্তিগত স্তরেও, জরুরি। আজ যা সামান্য, তা যে অসামান্য হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে!