লোকসভা ভোটের ময়দানে নয়া বিতর্কের কেন্দ্রে মঙ্গলসূত্র। হিন্দুদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে তা মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে, মোদির এহেন ইঙ্গিতে এবার পালটা ফারুকের। সব মিলিয়ে দুর্নীতি নয়, ভোটযুদ্ধে যেন ফের মাথা উঁচিয়ে উঠল সেই ধর্মই। শুনে নেওয়া যাক।
এক নেতা জনসভা থেকে বারে বারে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে হিন্দুরা বিপন্ন। দাবি করছেন হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র নাকি ছিনিয়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া হতে পারে। পালটা আরেক নেতার তোপ, কোনও প্রকৃত মুসলিম একজন হিন্দু মহিলার গলা থেকে মঙ্গলসূত্র খুলে নেওয়ার মতো কাজ করতেই পারে না। কারণ ইসলাম সব ধর্মকে সম্মান করার শিক্ষাই দেয়। এর মধ্যে কংগ্রেস নেত্রীও ইতিহাস টেনে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, দেশের জন্য নিজের মঙ্গলসূত্র বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর মা। লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে এই গোটা বিতর্কটাই আপাতত রাজনৈতিক মহলের গরম খবর। রাজস্থানের বাঁশোয়াড়ার পরে উত্তরপ্রদেশের আলিগড় থেকে যেভাবে মঙ্গলসূত্র নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন মোদি, তাতে বিভাজনের রাজনীতিই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ভোটের মধ্যে বিজেপি শিবির থেকে ধর্মকে টেনে এহেন মন্তব্য আসতেই পালটা দিচ্ছেন বিরোধীরাও। নরেন্দ্র মোদিকে বিঁধে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যেমন বলেছেন যুদ্ধ চলাকালীন ঠাকুমা ইন্দিরা তো দেশের নামে গয়না খুলে দিয়েছিলেনই, তাঁর মা-ও মঙ্গলসূত্র বিসর্জন দিয়েছেন দেশের জন্যই। অর্থাৎ রাজীব-হত্যার কথা মনে করিয়েই মোদির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। আর এবার এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন ফারুক আবদুল্লাও, যিনি নিজেও ধর্মে মুসলিম। ইসলাম ধর্মের আদর্শ মনে করিয়েই তাঁর সাফ বক্তব্য, কোনও প্রকৃত মুসলিম এভাবে অন্য ধর্মকে অসম্মান করে না। কিন্তু এই চাপানউতোরের জেরে দেখা যাচ্ছে, কার্যত মঙ্গলসূত্রকে ঘিরেই হঠাৎ আবর্তিত হচ্ছে দেশের রাজনীতি। আর এই চর্চার দরুন খানিক পিছিয়েই গেল একাধিক দুর্নীতির বড় ইস্যুগুলি। উলটে ফের ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধের পথেই যেন হাঁটছে চলতি লোকসভা নির্বাচনও।
আরও শুনুন:
ভোটের দিনে ধর্মনিরপেক্ষ প্রার্থীকে ভোট দেওয়াই তীর্থযাত্রা? ইঙ্গিত ধর্মগুরুর
বিজেপি শিবির থেকে ধর্ম নিয়ে বক্তব্য আসবে, এ কথা আর নতুন নয়। কিন্তু চলতি নির্বাচনে সে প্রবণতা খানিক কম ছিল বলেই মনে করছিলেন বিশেষজ্ঞরা। রাম মন্দির নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে আগেই হিন্দুত্বের জমি তৈরি করেছিল গেরুয়া শিবির, তার সঙ্গে সঙ্গত করেছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা সিএএ-র ঘোষণাও। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে মোদি গ্যারান্টি বা সরকারি প্রকল্পের সাফল্য নিয়েই অনেক বেশি কথা বলেছেন মোদি-শাহরা। যেভাবে সরকার গড়ার পরের পরিকল্পনাও তাঁরা তুলে ধরছিলেন, তাতে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে বিজেপি শিবিরের আত্মবিশ্বাসই ফুটে উঠছিল। শ্রাবণ মাস কি নবরাত্রিতে আমিষ খাওয়া কিংবা কংগ্রেসের ইস্তেহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ প্রকাশ পাচ্ছে, এ জাতীয় বিক্ষিপ্ত কিছু আক্রমণ ছিল ঠিকই। কিন্তু সব মিলিয়ে সংখ্যালঘু সমাজকে সেভাবে কাঠগড়ায় তুলতে দেখা যায়নি বিজেপিকে। কিন্তু এবার বিভাজনের রং মাখিয়েই কংগ্রেসকে তির ছুড়েছেন মোদি। সম্প্রতি হায়দরাবাদে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কোন শ্রেণির হাতে কত সম্পদ আছে তা সমীক্ষা করে দেখবে। সত্যি বলতে, সম্পদের বৈষম্য ঘোচাতে চাইলে এহেন সমীক্ষা করার কথা উঠতেই পারে। কিন্তু সেই বক্তব্যকে টেনে এনে মোদির দাবি, ‘‘অতীতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পদে সর্বাগ্রে অধিকার মুসলিমদের। সেই কারণেই সমীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস। যাতে দেশবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ মুসলিম ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়।’’ তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় এলে মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে কংগ্রেস, আর তারপর তা বিলিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, আসলে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন মোদি। মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্কে শান দিয়ে হিন্দুদের মধ্যে জাতিগত অসূয়া ফের জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। আর কংগ্রেস মুসলিম তোষণ করে, এমন বক্তব্য পেশ করে হাত শিবিরের ভোট কাটতে চাইছেন একইসঙ্গে।
আরও শুনুন:
মুসলিম মহিলারা কি স্বামীর কথায় ভোট দেবেন? বিশ্বাস করেন না বিজেপি প্রার্থী মাধবী লতা
আসলে, প্রথম দফার ভোটের হিসেব বলছে, গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং বিহার, মহারাষ্ট্রে বিজেপির পক্ষে ভোট কম পড়েছে। এমনকি গরমের দাবদাহ সয়েও মুসলিম ভোটারদের মধ্যে যে হারে ভোটদানের প্রবণতা দেখা গিয়েছে, হিন্দু ভোটারদের মধ্যে তা দেখা যায়নি বলেই মনে করছে বিজেপি। তা ছাড়াও বিজেপির অন্দরের বিশ্লেষণ, দলের প্রতি ক্ষোভও রয়েছে কর্মী-সমর্থকদের একাংশের। সব মিলিয়ে শেষমেশ লাভের ঘরে টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর তাতেই নড়েচড়ে বসেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। নির্বাচনের আগেই যুদ্ধে জয় হয়ে গিয়েছে বলে যে ধারণা পদ্মশিবিরে জাঁকিয়ে বসেছিল, কেবল সেই ভরসায় নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার কথা আর ভাবছেন না তাঁরা। বিজেপির মতে, সেই কারণে প্রচারের তূণ থেকে মেরুকরণের তিরই বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন মোদি। এদিকে মোদি বিভাজনের অস্ত্রে শান দিতেই, তার পালটা দিতে বাধ্য হচ্ছেন বিরোধীরা। ফলে কার্যত মোদির ঠিক করা নিয়মেই খেলতে হচ্ছে তাঁদেরও। পেগাসাস থেকে ইলেকটোরাল বন্ড- মোদি সরকারের আমলের যেসব বড় দুর্নীতি নিয়ে তাঁরা প্রচারে জোর দিচ্ছিলেন, তার জায়গা অনেকখানিই নিয়ে নিচ্ছে ধর্মকেন্দ্রিক বক্তব্য। সব মিলিয়ে, দুর্নীতিকে ছাপিয়ে ফের ধর্মের লড়াই-ই যেন মুখ্য হয়ে উঠছে লোকসভা নির্বাচনে।