প্রসঙ্গ একটিই। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রতিবাদে উত্তাল প্যারিসও। বিশ্ব জুড়ে দানা বেঁধে ওঠা আন্দোলন যেন একটি সামগ্রিক প্রবণতাকেই চিহ্নিত করছে। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
গণধর্ষণ। নারী নির্যাতন। আর তার প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষের পথে নেমে আসা। সোচ্চারে জানানো, এই অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেওয়া যাবে না। কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য লড়াই শুধু তাঁর একার নয়। সহনাগরিকরা মিলিত হয়েই সেই প্রতিবাদে অংশ নেবে। বিচ্ছিন্ন ভাবে নয়, বলা যায়, গোটা বিশ্বেই ক্রমশ দানা বাঁধছে এই আন্দোলন। সেই ছবি দেখা গেল প্যারিসেও।
কিছুদিন আগেই, ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল শহর কলকাতা। তিলোত্তমার সেই রাজপথ যেন মিশে গেল প্যারিসের রাজপথে। ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে উত্তাল সে-দেশ। সেখানেও রাজপথ ছেয়ে গিয়েছে হাজার হাজার মানুষে। কারও হাতে বেগুনি পোস্টার। কারও চোখ নিশ্চল, মুখ ঢাকা মুখোশে। কেউ মাথায় বেঁধেছেন লাল কাপড়। কেউ আবার নির্দ্বিধায় তাঁর পোশাক খুলে উড়িয়ে দিচ্ছেন হাওয়ায়। দাবি একটাই— থেমে যাক মেয়েদের ওপর সমস্ত রকম অত্যাচার।
প্যারিসের এই সাম্প্রতিক প্রতিবাদের সূত্রপাত এক নারকীয় ঘটনায়। নির্যাতিতার নাম জিসেল পেলিকট। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। জানা গিয়েছে, তাঁর প্রাক্তন স্বামী ডমিনিক পেলিকট-সহ আরও বহুজন তাঁর উপর অত্যাচার চালায় দিনের পর দিন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন,বহু পুরুষের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। নির্যাতনকারীর সংখ্যা ৫০ জনেরও বেশি। তবে মহিলার স্বামী-সহ ৫০ জন আপাতত আছে অভিযুক্তের তালিকায়। জানা গিয়েছে, নির্যাতনের আগে তাঁকে জোরপূর্বক মাদক সেবন করানো হত। এবং এই পুরো কাজটিই দীর্ঘদিন ধরে চলেছে তাঁর স্বামীরই তত্ত্বাবধানে। তবে ভয়ে বা সংশয়ে এই ঘটনা তিনি লুকিয়ে ফেলেননি। প্রকাশ্যে এনেছেন, শনাক্তকরণ করেছেন দোষীদের। এমনকী তাঁর স্বামীকেও। আদালতে এসে বলেছিলেন, এতগুলো বছর যে তিনি এমন একজন অপরাধীর সঙ্গে বাস করছেন— তা বিশ্বাস করতে তাঁর কষ্টই হচ্ছে।
প্যারিসের এই আন্দোলন যেন সামগ্রিক ভাবে একটা প্রবণতাকে চিহ্নিত করছে। নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ ক্রমশ রূপ নিচ্ছে সামাজিক গণআন্দোলনে। নগ্নতাও সেখানে হয়ে উঠেছে অন্যতম হাতিয়ার।
বিবস্ত্র হওয়া প্রতিবাদের একটি অন্যরকম ভাষা। কেননা নারীর শরীরের অধিকার তার নিজস্ব। আর সেই বয়ানকেই রাষ্ট্রের কাছে আরও খানিকটা সোচ্চারে প্রকাশ করতেই হাতিয়ার হয়ে ওঠে নগ্নতা। এই প্রস্তাব নিয়ে ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম ইউক্রেনে ‘ফিমেন’ নামক একটি গোষ্ঠী মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়। তাঁরা মেয়েদের উপর হওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে বলে নগ্নতার কথা। ২০১০ পরবর্তী সময় থেকে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিতে মেয়েদের বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে নেটদুনিয়া তোলপাড় হয়ে ওঠে একের পর এক মেয়েদের নগ্ন ছবি নিয়ে। প্রতিবাদের সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন প্যারিসের আন্দোলন। ফ্রান্সে এই আন্দোলনের অন্যমত উদ্যোক্তা ক্যারোলিনা জানিয়েছেন, গোটা দেশে হাজার হাজার মানুষ শামিল হয়েছেন এই আন্দোলনে। জানা গিয়েছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতেও নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান নেহাত কম নয়। ক্যারোলিনা বলেছেন, এই ধরনের প্রতিবাদের ফলে মহিলারা তাঁদের অভিযোগগুলো প্রকাশ করতে সাহস পাবে।
সম্প্রতি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তও। মাহসা আমিনির ঘটনাই তার প্রমাণ। ঠিকমতো হিজাব না পরার দোষে হত্যা করা হয় মাহসা আমিনিকে। আর ঠিক তারপর, তাঁর জন্য হাতে হাত ধরে রাস্তায় নেমেছিলেন ইরানের লক্ষাধিক মেয়ে। মাথার লম্বা চুল কেটে পতাকা বানিয়ে প্রতিবাদের নিশান উড়িয়েছিলেন তাঁরা। যে শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য এত নিদান, সেই শরীরকেই প্রকাশ্য দিবালোকে উন্মুক্ত করেছিলেন তাঁরা।
তার পরে আবারও সেই ইরানের সাহার খোদায়েরি। তাঁর অপরাধ পুরুষের ছদ্মবেশে ফুটবল স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করা। ঠিক যখন সেই অপরাধের বিচার হচ্ছে, ভরা আদালত চত্বরেই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। নিজেকে আগুনে আহুতি দিয়েছিলেন তিনি। তখনও ইরান গর্জে উঠেছিল উঠেছিল প্রতিবাদে। পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙতে নিজের মতো করেই নিজের প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিয়েছিলেন আহু দারিয়া। সেখানেও তাঁর হাতিয়ার ছিল পোশাকই। আহুর ঘটনাতেও উত্তাল হয়েছিল বিশ্ব।
নারীর উপর নির্যাতন কোনোভাবেই বরদাস্ত নয়। আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনও নারীর একার নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দানা বাঁধতে থাকা এই আন্দোলন যেন এই একটি মূলসূত্রে গাঁথা আছে। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদের ভিতরই যেন থেকে যাচ্ছে ক্ষমতাতন্ত্র ভাঙার ইশারা। নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে তো বটেই, বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তাই অন্যরকম গুরুত্ব থেকে যায় এই প্রতিবাদ আন্দোলনের। বিশ্ব জুড়ে আন্দোলনের এই সামগ্রিক ছবি যেন সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।