এই হত্যালীলা যেন নতুন করে উসকে দিয়েছে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ। যে মুহূর্ত শোকে স্তব্ধ হওয়ার কথা ছিল, তা যেন স্রোত নামিয়েছে ঘৃণাভাষণের। ধর্মনিরপেক্ষতা এই প্রেক্ষিতে আবার আক্রমণের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই যখন একদিককার অবস্থা, তখন কাশ্মীর জানান দিচ্ছে তার নিজস্ব সত্তা। সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতিবাদে সম্পূর্ণ ‘শাট ডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে উপত্যকা জুড়ে।
অনেক বছর পর আবার কাশ্মীরে আনাগোনা বেড়েছিল দেশবাসীর। পর্যটকরা আসছেন। খুশি কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। আচমকাই যেন ছন্দপতন। ২২ এপ্রিল যে নারকীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল কাশ্মীর, সেই রক্তাক্ত ভূস্বর্গ আবার ভয় ধরাচ্ছে অনেকের মনে। যে স্বাভাবিক ছন্দ পাহাড়ি নদীর মতোই বয়ে চলেছিল তা যে ব্যাহত হবে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেখানকার সাধারণ মানুষের আশা-ভরসাও অনেকটাই ধাক্কা খেল। আবার কবে সব স্বাভাবিক হবে, তা-ও অন্তত এই মুহূর্তে কারও জানা নেই। তবে, এই থমথমে পরিস্থিতিতে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। দ্বিধাহীনভাবেই তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই রক্ত-মৃত্যুর কাশ্মীর তাঁদের কাম্য নয়।
২৩ এপ্রিল, কাশ্মীরের একাধিক দৈনিক সংবাদপত্র্রের প্রথম পাতার রং কালো। শোক ও সংহতি প্রকাশের পাশাপাশি এই পরিবর্তন গভীর অর্থবাহী। নানা কারণেই এই ঘটনা যে অন্ধকারময় তা বুঝিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি উপত্যকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সংবাদপত্রে তারই প্রতিফলন। কাশ্মীর যে স্বাভাবিকতার লক্ষ্যে এগোচ্ছিল, তার উপরই আঘাত নেমে এসেছে। পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকা। সেখানে যেভাবে ধর্ম জেনে ও বুঝে হত্যালীলা চালিয়েছে জঙ্গিরা, তা গোটা দেশকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। আর সেই নৈঃশব্দের মধ্যেই যেন নতুন স্বর খুঁজে পেয়েছে কাশ্মীর। বলা ভালো, নতুন স্বরের জন্ম দিয়েছে কাশ্মীরের সাধারাণ মানুষ। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, মিছিল করেছেন। এবং এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। পর্যটকদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে এক টাট্টু ঘোড়াচালকের মৃত্যুও হয়েছে। সামগ্রিকভাবেই কাশ্মীর যে এই পরিস্থিতি চায় না, এই কথাটিই বারেবারে ধরা দিয়েছে তাঁদের প্রতিবাদে।
এদিকে, এই হত্যালীলা যেন নতুন করে উসকে দিয়েছে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ। যে মুহূর্ত শোকে স্তব্ধ হওয়ার কথা ছিল, তা যেন স্রোত নামিয়েছে ঘৃণাভাষণের। মৃত স্বামীর দেহের পাশে পাথর হয়ে বসে আছেন স্ত্রী। এ দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। সে-দৃশ্য দেশকে বিচলিত করেছে. অস্থির করেছে, রাগিয়েও দিয়েছে। সেই রাগের একাংশ আবার বিভেদেই ইন্ধন জুগিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এই প্রেক্ষিতে আবার আক্রমণের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই যখন একদিককার অবস্থা, তখন কাশ্মীর জানান দিচ্ছে তার নিজস্ব সত্তা। সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতিবাদে সম্পূর্ণ ‘শাট ডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে উপত্যকা জুড়ে। একান্ত প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানগুলি ছাড়া বাকি সবকিছুই বন্ধ আছে সেখানে। রাস্তাঘাটে জনপরিবহনের সংখ্যাও একেবারে কম। বন্ধ রয়েছে প্রাইভেট স্কুলগুলোও। কাশ্মীরী মসজিদ ‘কিশ্তোয়ার’ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। মসজিদ বন্ধ রাখারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঘটনার সন্ধেতেই কাশ্মিরী স্থানীয়রা একত্রিত হন মোমবাতি হাতে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও নিহতদের বিচার চেয়ে স্লোগান দেন তাঁরা। জানিয়ে দেন, পর্যটকরাই তাঁদের প্রাণ।
এই মুহূর্তে কাশ্মীরের এই ঘটনা নিয়ে নানা ধরনেরই আলোচনা চলছে। কাশ্মীর স্বাভাবিক হবে এখন এই আশাই করতে পারে মানুষ। আর সেই সঙ্গে ভরসা যে, সারা দেশ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ, সেখানে ভরসা জোগাচ্ছে কাশ্মীরও। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষও। না, সহনাগরিকের রক্ত নয়, সহাবস্থানই প্রার্থনা করছে কাশ্মীর। সাধারণের এই প্রতিবাদই স্বাভাবিকতায় ফিরতে যে কাশ্মীরের বড় ভরসা, তা বলাই যায়।