রাহুল গান্ধীর ভারত-জোড়ো-যাত্রা যাত্রা ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসাবে তাঁকে দেখতে যে আপত্তি নেই, এমনই দরাজ সার্টিফিকেট নীতিশ কুমারের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের। ভারতীয় রাজনীতিতে এই যাত্রা কতটা বদল আনবে, তা তো সময়ই বলবে। তবে আর একটা বদল নিয়েও এই মুহূর্তে আলোচনা বেশ তুঙ্গে। তা হল রাহুল গান্ধীর লুক-বদল। একমুখ দাড়িগোঁফে যেভাবে দেখা যাচ্ছে রাহুলকে, তা কি নেহাতই স্টাইল! নাকি এর নেপথ্যেও আছে কোনও রাজনৈতিক বার্তা? আসুন শুনে নিই।
কেউ করেছেন কৌতুক। গেরুয়া শিবিরের নেতারা টিপ্পনিও কেটেছেন। আর নেটদুনিয়াতে তো নানা মতের ঝড়। রাহুল গান্ধীর নয়া লুক নিয়ে চর্চা সর্বত্র। শুধু এ নিয়ে যেন হেলদোল নেই খোদ রাহুলের। একমুখ দাঁড়িগোফ নিয়েই দেশের পথে পথে হেঁটে চলেছেন তিনি। বার্তা একটাই, ঘৃণার বাতাবরণ সরিয়ে দেশে ভালবাসার কথা ছড়িয়ে দেওয়া। বিজেপির রাজনৈতিক আদর্শের মোকাবিলা করতে পথকেই নতুন পথ হিসাবে বেছে নিয়েছেন রাহুল। তবে তাঁর যে এই বেশ-বদল, তা কি নেহাতই স্টাইল! নাকি যাকে ফ্যাশন দুনিয়ায় বলা হয়, ‘কেয়ারফুলি কেয়ারলেস’ তাই-ই রপ্ত করেছেন রাহুল। ভারত-জোড়ো-যাত্রা যেমন সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে, তেমনই রাহুলের এই রূপ-বদল নিয়েও হচ্ছে বিস্তর আলোচনা।
আরও শুনুন: চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন রাহুল গান্ধী! সোনিয়া পুত্রকে ‘বিদেশি’ বলে তোপ বিজেপি নেতার
রাহুল গান্ধী যে এই প্রথম দাড়ি রাখছেন তা নয়। ক্লিন শেভ লুকে তাঁকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় বটে, তবে এর আগেও তাঁকে দাড়ি রাখতে দেখেছেন দেশবাসী। তা নিয়ে রাজনীতির অন্দরে চলত মশকরাও। কেউ কেউ আড়ালে বলতেন, পার্লামেন্টের চলতি সেশনের মধ্যেই তিনি বিদেশ চলে যেতে পারেন, তাই পরিচয় গোপন করতেই হঠাৎ হঠাৎ একমুখ দাড়িগোঁফ রাখেন রাহুল। এ অবশ্য আড়ালের রাজনোইতিক রসিকতা। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়েই দেশবাসীর সামনে ধরা দিয়েছেন রাহুল। প্রশ্ন হল, তাহলে তাঁর এবারের লুক নিয়ে কেন এত চর্চা? নেহাত স্টাইল স্টেটমেন্ট বলেই তো তা উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু গেরুয়া শিবিরের নেতারা যেভাবে এই নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন, তাতে রাহুলের এই রূপবদলকে নেহাত স্টাইল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অসমের মুখমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা রাহুল গান্ধীকে এই প্রসঙ্গে ইতিমধ্যেই কুখ্যাত সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামদাস আটওয়ালে বলেছেন, রাহুল গান্ধীর দাড়ি বাড়ছে মানেই লোকসভায় কংগ্রেসের আসন বাড়বে, এমনটা ভাবা কোনও কাজের কথা নয়। ভারত-জোড়ো-যাত্রা যে শাসকদলকে খানিকটা হলেও চিন্তিত করেছে, তা এই ধরনের মন্তব্য থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। এদিকে নেটদুনিয়ার রসিক বাসিন্দারা তো কার্ল মাক্সের সঙ্গে রাহুলের ছবি জুড়ে ইতিমধ্যে পোস্টও করে ফেলেছেন।
আরও শুনুন: ‘মন্দিরে গেলে কটাক্ষ, গুরুদ্বারে গেলে হয় না তো?’ রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কানহাইয়ার
রাহুলের রূপ-বদল নিয়ে টুকটাক মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেতারাও। এ প্রসঙ্গে জয়রাম রমেশের মন্তব্য, ‘তাঁরা দেশ বদলাতে এসেছেন, বেশ নয়’। অর্থাৎ বেশভূষা বা চেহারায় বদলটা বড় ব্যাপার নয় বলেই সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। এ নিয়ে বেশ কিছু মতবাদও ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। বলা হচ্ছে, এই যাত্রাই এখন রাহুল গান্ধীর ধ্যানজ্ঞান। তাই দাড়ি কাটার মতো সময়ই পাচ্ছেন না রাহুল। নেতারা যেখানে গাড়ি ছাড়া একটুও নড়েন না, সেখানে রাহুল পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এরপর আর তাঁর নিজের চেহারার দিকে লক্ষ্য করার সময় নেই। এই মতবাদ একটা কথাই তুলে ধরতে চায় যে, রাহুল গান্ধীর কাছে এই যাত্রা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দ নয়, ভারতবর্ষের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখাই যে তাঁর লক্ষ্য, খুব সঙ্গোপনে এই রূপবদলে হয়তো সে কথাই বলে চলেছেন রাহুল। তবে মোক্ষম একটি কথা বলেছেন দিলীপ চেরিয়ান। কমিউনিকেশন কনসালট্যান্ট এবং পলিটিক্যাল ক্যাম্পেনের উপদেষ্টা হিসাবে তিনি বিখ্যাত। তিনি কিন্তু রাহুল গান্ধীর এই দাড়ি রাখাকে স্রেফ স্টাইল বলে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বরং তাঁর মতে, রাহুল যেন নিজেকে একজন ভিক্ষুক সন্ন্যাসী হিসাবেই তুলে ধরছেন। মাধুকরী ব্রত নিয়ে যে সন্ন্যাসীরা এই দেশে ঘুরতেন বা ঘোরেন, অনেকটা সেরকম ভাবেই সাধারণ মানুষের মাঝে ধরা দিচ্ছেন রাহুল। আর জনতার সঙ্গে এই পায়ে পা মিলিয়ে চলার দরুন, সাধারণ মানুষ রাহুলকে একজন ‘ভ্রাম্যমান ফকির’ হিসাবেই দেখছেন। ঠিক এইখানেই সহায়ক হচ্ছে রাহুলের একমুখ দাড়ি-গোঁফের এই লুক। একটু পিছু ফিরে তাকালে দেখা যাবে, নিজেকে একজন ফকির হসাবেই একদা তুলে ধরেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। সেদিন সেই ইমেজের জবাব দেওয়ার মতো পুঁজি রাহুলের হাতে ছিল না। আজ যখন সেই মোদির রাজনৈতিক আদর্শেরই মোকাবিলা করতে তিনি পথে নেমেছেন, তখন পালটা নিজেকে সন্ন্যাসী কিংবা ফকির হিসাবেই তিনি নিজেকে তুলে ধরতে চান। এবং তাঁদের চেহারার যেরকম ছবি জনমানসে ধরা আছে, সেই রূপেই তিনি সামনে এসেছেন। তাই হয়তো রাহুলের যাত্রার মতো তাঁর লুকও ভাবিয়েছে শাসকদলের নেতাদের। প্রত্যাশিত ভাবেই ছুটে এসেছে টিপ্পনি-মশকরা। আর উত্তরে নীরব থেকেছেন রাহুল।
আরও শুনুন: দুই ভারতের গল্প… রাহুলের বক্তৃতা কি কমেডিয়ান বীর দাসের লেখা? প্রশ্ন নেটদুনিয়ায়
ভারত-জোড়ো-যাত্রার সাফল্য দেশের ভোটবাক্সের রাজনীতিতে কতটা প্রতিফলিত হবে, তা অবশ্য বহু অঙ্ক পেরিয়েই বোঝা সম্ভব। তবে ইতিমধ্যে তা যে যথেষ্ট চর্চা এবং আগ্রহের জন্ম দিতে পেরেছে, তা বলাই যায়। আর তাই রাহুলের একমুখ দাড়ি-গোঁফ আপাত ভাবে হয়তো কিছুই নয়। তবু তার নেপথ্যে যে একরকমের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বার্তাও থেকে যাচ্ছে, তা-ও একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।