দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, আদতে বিবাহ একটা সামাজিক চুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধহয় পারষ্পরিক সম্মান ও বিশ্বাস। সেখানে একটু নড়চড় হলেই সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। কখনও কখনও সেই মনোমালিন্য এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, যে তা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াতে সময় লাগে না। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ কোনও বড় ব্যাপার নয়। অসুস্থ সম্পর্কের তুলনায় সুস্থ বিচ্ছেদ বহুগুণে শ্রেয় বলেই মনে করেন অনেকে। সম্পর্কে পারষ্পরিক সম্মানের বিষয়ে এবার গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ জানাল কেরালা হাই কোর্ট। ঠিক কী বলল আদালত? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সুস্থ বৈবাহিক সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একে অপরের প্রতি সম্মান ও বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত থাকাটা একান্ত জরুরি। আর এবার সেদিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করল কেরলা হাইকোর্ট। একটি বৈবাহিক মামলার শুনানি চলছিল কেরালা হাই কোর্টে। যেখানে স্বামীর বিরুদ্ধে নির্মমতার অভিযোগ এনে নিম্ন আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করেছিলেন এক মহিলা। সেখানে তাঁর ডিভোর্সের আবেদন মঞ্জুর করে কোর্ট। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন স্বামী। সেই মামলাতেই সম্প্রতি রায় দিয়েছে হাইকোর্টের বিচারপতি অনিল কে নরেন্দ্রান ও বিচারপতি সিএস সুধার ডিভিশন বেঞ্চ।
আরও শুনুন: বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্তিতে চলল মিষ্টি বিতরণ, কী বলছেন বিলকিসের স্বামী?
ওই মহিলা আদালতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী লাগাতার তাঁকে অসম্মান করেন। এমনকী চোখে আঙুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দেন, কোনও ভাবেই তিনি তাঁর স্বামীর যোগ্য নয়। দেখতে, শুনতে এমনকী গুণের দিক দিয়েও তিনি যে তাঁর স্বামীর চাহিদা মেটাতে অপারগ, তা বারবার বুঝিয়ে দিতেন ওই ব্যক্তি। অন্য মহিলাদের সঙ্গে তুলনা টেনে বারবার তাঁকে অপমান করা হত বলেই নিম্ন আদালতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন আবেদনকারী ওই মহিলা। যার জেরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছিলেন তিনি। সেই মামলায় বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন মঞ্জুর করা হয় পরিবার আদালতের তরফে।
নিম্ন আদালতের সেই রায় পুনর্বিবেচনা জন্য কেরালা হাই কোর্টের শরণাপন্ন হন ওই ব্যক্তি। আর সেই মামলার শুনানিতে আবেদনকারীকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে হাই কোর্ট। পাশাপাশি সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে তুলনা টেনে স্ত্রীকে বিদ্রুপ বা অসম্মান করা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকী তা অপরাধেরও শামিল। এমনটাই জানিয়েছেন বিচারপতিদের ডিভিশন বেঞ্চ। তাঁদের বক্তব্য, অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে তুলনা টেনে অসম্মান, ধারাবাহিক বিদ্রুপ একরকম ভাবে মানসিক নির্যাতন বলেই গণ্য করা হবে। এমনকী সঙ্গীকে অযোগ্য বলে কথা শোনানোও একই রকম নির্যাতনের মধ্যে পড়বে বলেও সাফ জানিয়েছে আদালত। আর সেক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করতেই পারেন স্ত্রী। আর তা গ্রহণও করবে আদালত।
আরও শুনুন: সদ্যোজাত কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হল মাটিতে , ‘বেটি বঁচাও’-এর উল্টো পথেই কি হাঁটছে দেশ?
স্বভাবতই মামলাকারীর সমস্ত আবেদন খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্ট। অর্থাৎ নিম্ন আদালতের রায়কেই বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ডিভিশন বেঞ্চের তরফে। আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও অনেক সময়ই ডিভোর্সকে ভালভাবে নেয় না সমাজ। জোর করে কোনও মতে বিবাহকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়ে গিয়েছে আজও। তবে অসুস্থ, অসম্মানজনক সম্পর্কের থেকে বেড়িয়ে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলেই এই মামলায় ইঙ্গিত দিয়েছে আদালত। শুধু তাই নয়, শুধুমাত্র শারীরিক নিগ্রহ নয়, বৈবাহিক সম্পর্কে লাগাতার অপমান, মানসিক নির্যাতনও যে একরকম ভাবে অপরাধের মধ্যে পড়ে, তা-ও পরিষ্কার করে দিয়েছে উচ্চ আদালত।