সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কুয়াশা আমাদের দেশকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রায়শই শোনা যায় এ কথা। তা অমূলক নয়। বিভিন্ন ঘটনাবলি সেই ইঙ্গিত খানিকটা দেয় বইকি। তবে সেটাই কিন্তু সামগ্রিক ছবি নয়। এই দেশ, শান্তি ও সহাবস্থানের। তাই বিচ্ছিন্ন অশান্তির ঘটনা ঘটতে থাকলেও, সেই বাতাবরণ পেরিয়ে ফুটে ওঠে আসল ভারতবর্ষের ছবি। এই ভারতবর্ষেই তাই এখনও মন্দিরে হয় ইফতারের আয়োজন। ধার্মিক মুসলমানদের আমন্ত্রণ জানান স্বয়ং মন্দিরের পুরোহিত। আসুন শুনে নিই।
চলছে রমজান মাস। এই সময় ধার্মিক মুসলমান যাঁরা, তাঁরা রোজা পালন করেন। দিনভর উপবাসের পর দিনান্তে মুখে তোলেন খাবার। যাকে বলা হয় ইফতার। সেই ইফতারেরই আয়োজন হল গুজরাটের এক মন্দিরে। আয়োজন করলেন স্বয়ং মন্দিরের পুরোহিত। সম্প্রীতির অপূর্ব নিদর্শন হিসাবেই উঠে এসেছে এই দৃশ্য।
আরও শুনুন: ‘মুসলমানদের দখলে’ আমের বাজার! মুসলিম ফল বিক্রেতাদের বয়কটের ডাক কর্ণাটকে
গুজরাটের বীর মহারাজ মন্দির এক ঐতিহাসিক স্থান। প্রায় ১২০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির সে রাজ্যের অন্যতম এক দর্শনীয় স্থানও বটে। সেখানেই প্রথমবার রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য আয়োজন হল ইফতারের। হাজার বছরের পুরনো মন্দির দেশের সম্প্রীতির আত্মাটিই যেন তুলে ধরল দলবানা গ্রামের বাসিন্দাদের সামনে। বলা ভালো, গোটা দেশের সামনেই। এই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই হিন্দু। তুলনায় কম সংখ্যক মুসলমানেরই বাস, যাঁদের পেশা মূলত কৃষিকাজ। কেউ কেউ ব্যবসাও করেন। তাঁদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মন্দির চত্বরেই মগরিবের নমাজ সমাধা করে যেন তাঁরা রোজা ভাঙেন – এই বলেই ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু ভাইরা। ইফতারের আয়োজন করেছিলেন মন্দিরে পুরোহিত পঙ্কজ ঠাকর। মধ্য পঞ্চাশের প্রৌঢ় বলছেন, এই প্রথমবার দলবানা গ্রামে এরকম ঘটনা ঘটল। এ বছর রমজানের মধ্যেই পড়েছে রামনবমী। দুই সম্প্রদায়েরই উৎসবের ক্ষণ এসে মিলেছে এক বিন্দুতে। তাহলে মানুষগুলোই বা মিলবে না কেন? এই ভাবনা থেকেই এমন ছকভাঙা সিদ্ধান্ত। মন্দির কর্তৃপক্ষ এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুরোহিত মশায় স্বয়ং গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় মসজিদের মৌলানা সাহেবকে। তাঁরা সকলেই সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন।
আরও শুনুন: মানুষের মতো কথা বলতে পারে ব্যাঙের ছাতাও! গবেষণায় উঠে এল আশ্চর্য তথ্য
এরকম আমন্ত্রণ পেয়ে অভিভূত সে গ্রামের মুসলমান বাসিন্দারাও। জনৈক গ্রামবাসী বলছেন, এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই হয়েই বাস করে। হিন্দুদের উৎসবেও মুসলমানরা সাহায্য করেন। এবার তাঁদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন হিন্দুরা। বাসিন্দাটি জানাচ্ছেন, এই আমন্ত্রণ তাঁদের সকলের কাছেই অন্যতম আবেগঘন মুহূর্ত। একই কথা বলছেন গ্রামের সরপঞ্চও। বলছেন, হোলি কিংবা রামনবমীর সময় মুসলমান ভাইরাও তো এগিয়ে আসেন। হিন্দুদের কত কাজে সাহায্য করেন। তাই এবার মুসলমানদের উৎসবেও এগিয়ে গিয়েছে হিন্দু ভাইরা। তাঁর তাই আশা, তাঁদের গ্রামের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গোটা দেশের সামনেই নমুনা হয়ে উঠুক।
বাস্তবিকই দেশ যখন বিভাজনের বিষে জর্জর, তখন এই হাতে-হাত রাখা, দুই সম্প্রদায়ের এই ভাতৃত্ববোধের এই নমুনা যেন নেমে এসেছে উপশম হয়েই। হাজার বছরের পুরনো মন্দির চত্বরে সন্ধের আবছা অন্ধকারেই যেন ফুটে উঠেছিল সম্প্রীতিতে উজ্জ্বল ভারতবর্ষের অপূর্ব আলো।