পথেঘাটে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে যিনি সাহায্য করবেন, তাঁকে ২৫,০০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। অর্থাৎ ‘গুড সামারিটান’ হওয়ার বিনিময়মূল্য ২৫ হাজার টাকা। যা সহ-নাগরিকের কর্তব্য হওয়া উচিত, তার জন্য যখন পুরস্কারের মূল্য বাড়াতে হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে সমাজের আন্তরিকতা নিয়েই।
হাল্লা রাজা হলে নিশ্চিতই বলতেন, ‘গুড সামারিটান’ কি কম পড়িয়াছে? না বলার কারণও নেই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি ঘোষণা করেছেন যে, পথেঘাটে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে যিনি সাহায্য করবেন, তাঁকে ২৫,০০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। অর্থাৎ ‘গুড সামারিটান’ হওয়ার বিনিময়মূল্য ২৫ হাজার টাকা। আগে যে এই পুরস্কারমূল্য ছিল না, তা নয়। তবে, সেই হাজার পাঁচেক টাকায় কাজ না হওয়াতেই পুরস্কারের অর্থ অন্তত ৫ গুণ বাড়ানোর ঘোষণা করেছেন মন্ত্রী।
তাঁর প্রস্তাব যে সাধু উদ্দেশ্যে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তি যাতে গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে অন্তত চিকিৎসা পান, তা নিশ্চিত করতেই সরকারের এই পদক্ষেপ। তবে সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য যেভাবে পুরস্কারের অর্থমূল্য বাড়াতে হচ্ছে, তা বোধহয় কিছু প্রশ্নচিহ্নকেও সমাজের সামনে তুলে ধরে। একজন পথচলতি মানুষ দুর্ঘটনায় পড়লে, সহ-নাগরিক হিসাবে যে কোনও ব্যক্তিরই কর্তব্য তাঁকে সাহায্য করা। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সরকারি এই পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিচ্ছে, নাগরিকরা সে দায়িত্ব সেভাবে পালন করেন না। অন্যের বিপদ থেকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যেন নাগরিকের কাছে সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার একটা বড় কারণ, দুর্ঘটনার দরুন নানা আইনি বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয়। সেই ‘ঝামেলা’ এড়াতে দেখেও-না-দেখে দুর্ঘটনা এড়িয়ে যান অনেকে। আবার বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভিডিও দেখা যায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে মারাত্মক একটা কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু তা নিবারণের চেষ্টা না করে যেন ভিডিও তোলাই প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে! পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সরকারকে নতুন করে টাকা দিয়ে ‘গুড সামারিটান’ হতে উৎসাহ দিতে হচ্ছে। তাও বাচ্চাদের নয়, প্রাপ্তবয়স্কদের। এই প্রস্তাবে যে সরকারকে পৌঁছতে হচ্ছে, তাতে বোধহয় আমাদের লজ্জিত হওয়াই উচিত।
আরও শুনুন: বিভেদের রাজনীতি যতই ঘিরে থাকুক, ইউনুস-আফসারদের ছাড়া কুম্ভমেলাও অচল
এই ঘটনা যেন আমাদের অমানবিক মুখটিকেই আর একবার প্রকাশ করে দিল। অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো, যা কিনা সহজাত ছিল, তা যেন আর নেই। সমাজের বাঁধন-বুনিয়াদ তো এই পারস্পরিক সহায়তার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। একজন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যও যদি বেশি অর্থমূল্যের প্রত্যাশা করতে হয়, তবে সমাজের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমপ্যাথির গুরুত্ব নিয়ে বহু চর্চা হয়। তত্ত্ব দিয়ে তা আর কতটুকু বোঝা সম্ভব! বোঝা যায় এই মানুষে-মানুষে পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতাতেই। সেই জায়গাটি যে আজ কতখানি নড়বরে হয়ে গিয়েছে, মন্ত্রীর ঘোষণা যেন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
তবে, এর পরেও আমরা ‘গুড সামারিটান’ হব কী! ফিরে কি তাকাব নিজেদের দিকে! এ-প্রশ্ন তোলা থাকল নিজেদের কাছেই।