বাইরে তো হাজার রকম বিপদ ওঁৎ পেতেই থাকে সবসময়। কিন্তু ঘরেই যে তার জন্য ঘাপটি মেরে রয়েছে আরও বড় বিপদ, তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বছর চারেকের ছোট্ট মেয়েটা। অশিক্ষা ও কুসংস্কার যে মানুষকে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা-ই ফের প্রমাণ করে দিল এই ঘটনা। সৌভাগ্য ফেরাতে দেবতার পায়ে নিজের মেয়েকে উৎসর্গ করলেন খোদ বাবা। বাবার তুকতাকের ঠেলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল একরত্তি। অন্য কোথাও নয়, খোদ এদেশেই ঘটেছে এমন ঘটনা। কোথায়? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
অশিক্ষার থেকে বড় অন্ধকার আর নেই। আর সেই অশিক্ষাই মানুষকে ঠেলে দেয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের দিকে। যা কখনও কখনও এতটাই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে একজন বাবাকে করে তোলে নিজের সন্তানেরই হত্যাকারী। সম্প্রতি এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকল অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরের একটি গ্রাম। যেখানে বাবার তুকতাকের জেরে মৃত্যু হয়েছে একটি বছর চারেকের শিশুর।
নেল্লোরের আত্মাকুরের কাছে ছোট্ট গ্রাম পেরারিদ্দিপাল্লে। বছর চারেক আগে দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দেন বেণুগোপাল ও যামিনী নামে এক দম্পতি। ভালই চলছিল। দিন কয়েক আগেই ফসলের দেখাশোনা করার জন্য কোপ্পেরাপাড়ুতে দুই সন্তানকে নিয়ে নিজের বাবা-মায়ের বাড়িতে যান যামিনী। গত মঙ্গলবার রাতেই সেখানে গিয়ে দুই সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে আসে বেণুগোপাল। আর সেটাই কাল হল।
আরও শুনুন: ডাইনি অপবাদ থেকে পদ্ম সম্মান, অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে ওঠার গল্প শোনান ছুটনি মাহাতো
কিছু দিন ধরেই নাকি অর্থনৈতিক ভাবে চাপে ছিল বেণুগোপাল। আর সে কারণেই হঠাৎ সৌভাগ্য ফেরানোর ভূত চেপে বসে বেণুগোপালের মাথায়। স্থানীয় এক তান্ত্রিকের বুদ্ধিতে বাড়িতে শুরু হয় পূজাপাঠ আর তুকতাক। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, বুধবার থেকেই ওসব করছিল বেণুগোপাল। আর তার অঙ্গ হিসেবেই মেয়েকে জোর করে সিঁদুর আর হলুদ খাওয়ানোর চেষ্টা করে সে। একরত্তি মেয়েটার মুখে এমন ভাবে সিঁদুর ও হলুদ চেপে দেওয়া হয়, যাতে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার উপায়টুকু ছিল না শিশুটির। চিৎকার করলে এমন ভাবে তার ঘাড় চেপে ধরে বেণুগোপাল, যে বাচ্চাটির শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ওই ভাবেই গত তিন দিন ধরে বাড়িতে পড়েছিল শিশুটি।
ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় বেণুগোপালের বাড়িতে যান প্রতিবেশীরা । শিশুটিকে উদ্ধার করে নেল্লোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করান তাঁরাই। সেখান থেকে পরে চেন্নাইয়ের করপোরেট হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয় শিশুটিকে। তবে শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচানো যায়নি তাকে। অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় একরত্তি। প্রতিবেশী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে বেণুগোপালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আরও শুনুন: কোভিড নয়, রাস্তায় ঘুরছে ‘মানুষখেকো পিশাচ’! লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামবাসীরাই
কুসংস্কারের বশে এ দেশে আজও এমন এমন কাজকর্ম হয়, যা দেখলে সময়টাকে একবিংশ শতাব্দী বলে ভাবতে কষ্ট হয়। ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে খুন থেকে শুরু করে কালোযাদু বা তুকতাক, সমস্ত কিছুই চলে আজও দেশের বহু অংশে। বহু প্রচার, সচেতনতা, আইনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও ঠেকানো যায়নি এই প্রবণতা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পুরুলিয়ায় ঘটেছিল এমনই একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ড। সাড়ে তিন বছরের একটি শিশুর সারা শরীরে সূচ ফুটিয়ে নির্মম ভাবে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল তার মা আর এক তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের সেই ঘটনায় অভিযুক্তদের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করে আদালত। তবে এত কিছুর পরেও যে অশিক্ষার হাত থেকে আজও রক্ষা পায়নি এ দেশ, তারই প্রমাণ অন্ধপ্রদেশের এই নারকীয় ঘটনা। কবে কাটবে এই কুসংস্কারের অন্ধকার? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।