গোটা বিশ্বজুড়েই বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। কেন নষ্ট হচ্ছে শিশুদের ভবিষৎ? তাতে কতটা প্রভাব ফেলল করোনা মহামারী?
অভাবের সংসার। পুজোর সময় বাবার এনেছে সস্তা ছিটের জামা। এক ভাই তা পরলেও আর এক ভাই ছিল নারাজ। মধু-বিধু – এই দুই ভাইয়ের গল্প আমরা পড়েছি রবি ঠাকুরের কবিতায় । কিন্তু করোনা পরিস্থিতি এবং লকডাউনের জেরে, আজকের মধু-বিধুরা সাটিনের জামা নিয়ে আর মনে হয় ভুলেও ঝগড়া করে না। বরং তাদের অনেকেই ভুলতে বাধ্য হয়েছে অনেককিছু। ভুলেছে বইপত্তর, তুলে রেখেছে পেনসিল বাক্স। ভূগোলের মানচিত্র, ইতিহাসের সন তারিখ, অথবা বাংলা কবিতা-গল্প। এখন কেউ নদীর পাড় থেকে শাক তুলে বিক্রি করে। কেউ সাইকেল নিয়ে সব্জি বা ফল বিক্রি করে পাড়ায় পাড়ায়। কেউ বা কাজ হারানো বাবা মায়ের সঙ্গে রাস্তায় নেমে রোজগারে সাহায্য করে। গোটা দেশের নানা প্রান্তে প্রায় প্রতিদিনই দেখা দিচ্ছে এমন দৃশ্য। এই করোনাকালে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশু কিশোরদের ভবিতব্য হয়ে উঠছে এমনই। বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যা, বাড়ছে আশঙ্কা এবং উদ্বেগও।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন-এর হিসেব অনুযায়ী দেশের প্রায় পাঁচ কোটি কুড়ি লক্ষ শিশু বর্তমানে শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অন্তত ছাপান্ন শতাংশ শিশু স্কুলের মুখ দেখেনি বা স্কুলছুট।
মহামারীর সময় শিশুশ্রমিক বাড়ার রয়েছে যথেষ্ট কারণ। কোভিড আক্রান্ত হয়ে পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যের মৃত্যু, লকডাউনের ফলে কাজ হারানো, কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, ঋণের বোঝা ক্রমশ বাড়তে থাকা- এই ধরণের বিপর্যয় যত বেড়ে, তত বেড়েছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও। বিশেষত নিম্নবিত্ত পরিবার এবং আর্থিকভাবে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেড়েছে এই সমস্যা।
এদিকে প্যানডেমিকের কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ স্কুল। ফলে পরিবারের রোজগার বাড়াতে বা অন্নসংস্থানের জন্য অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেও শিশুশ্রমিকের চাহিদা এবং জোগান দুইই বেড়েছে হু হু করে।
দেশের মোট ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রায় ৪৮% মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলেই আশঙ্কা। বিশেষত গ্রামের দিকে যাদের বাস, বয়স চোদ্দ পনেরো, তাদের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা বেশি। স্কুল বন্ধ থাকার দরুন অন্যের বাড়িতে গেরস্থালির কাজে সাহায্য করা, কারখানা এবং কৃষিজমিতে কাজের জন্য তাদের পাঠানো হচ্ছে। পরিবারের বোঝা লাঘবের জন্য আকছার বিয়েও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
২০২০-র শুরুতে উইনিসেফ এবং আইএলও-র যৌথ পরিসংখ্যান থেকে জানা গিয়েছে, পৃথিবীতে ১৬ কোটি শিশু শ্রমের জোয়াল টানতে বাধ্য হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মেয়ে এবং সাড়ে ৯ কোটি ছেলে। দেখা যাচ্ছে, প্রতি দশ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে যুক্ত। এই সংখ্যাবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে পৃথিবীজোড়া করোনার ভয়াবহ অবস্থা, এবং লকডাউন। পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগ তৈরি করে জানাচ্ছে, ২০২২-এর শেষে আরও ৯ কোটি শিশু এই তালিকার আওতায় চলে আসবে।
আবার ভারতেই রয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, রেল স্টেশন, তার আশেপাশের বস্তি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে শিশুদের সংখ্যা এক লক্ষ বাইশ হাজারের কাছাকাছি। তাদের অনেকেরই জীবন উদ্দেশ্যহীন। শ্রম, যৌন নিপীড়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তি তাদের রোজনামচা।
তবে এই অন্ধকারই শেষ কথা নয়। দেশ জুড়ে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে এইসব শিশুদের শৈশবকে নষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। রয়েছে সরকার নির্ধারিত চাইল্ড লাইন-এর ফোন নাম্বার ১০৯৮। এর সঙ্গে প্রয়োজন সহনাগরিকের সহমর্মিতা। মানুষ হয়ে যদি মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, তাহলেই হয়তো বেঁচে যেতে পারে একটি শিশুর ভবিষ্যৎ।