বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার বোধহয় হয়ে উঠেছে ধর্ম। বিজেপির মতো হিন্দুত্ববাদী দলগুলি যেখানে রামের নাম নিয়ে বিভাজনের খেলায় মেতেছে। রাষ্ট্রজুড়ে ক্রমাগত বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, সেখানে দাঁড়িয়ে রামের হাত ছাড়তে নারাজ বিজেপি বিরোধী দলগুলোও। কিংবা হয়তো বিজেপির ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানের অ্যান্টিডোট হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে রামায়ণেরই অন্যতর কোনও ব্যাখ্যাকে। অন্তত ছত্তিশগড় রাজনীতির মতিগতি দেখে তো তেমনটাই ঠাওর হচ্ছে। সেই ফর্মুলা মেনেই রামনামে মেতেছে সে রাজ্যের কংগ্রেস শাসিত সরকার।
রামায়ণ ঘিরে আজকাল যতই একমুখী ব্যাখ্যা বা প্রচার চলুক না কেন, এই শতাব্দী প্রাচীন মহাকাব্যের যে হরেক ব্যাখ্যা, হরেক তাৎপর্য, তা বোধহয় সকলেরই জানা। কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু রাজনৈতিক দলই নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দার জন্য সেটাকে একমুখী ভাবেই ব্যাখ্যা করে চলেছে। আর সেটার দিকেই এবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ছত্তিশগড়়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল।
সম্প্রতি ছত্তিশগড়়ের শিবারিনারায়ণ মন্দির কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অযোধ্যা থেকে যে পথ ধরে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গিয়েছিলেন রাম, সেই পথের একটি রুটম্যাপ তৈরি করে গোটাটাকে একটা পর্যটন সার্কিট হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা নিয়েছেন সে রাজ্যের সরকার। সেই ‘রাম বনগমন’ প্রকল্পের অন্যতম একটি এই শিবারিনারায়ণ কমপ্লেক্স। এই সংস্কারের কাজের জন্য ইতিমধ্যেই ধার্য হয়েছে প্রায় ১৩৪ কোটি টাকার বাজেট।
এর পাশাপাশি রামায়ণের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ক্যাফেরও উদ্বোধন করেছেন বাঘেল। না, শুধু ক্যাফে বললে অবশ্য তাকে ভুল বলা হবে। কারণ সেখানে থাকছে রামায়ণের ব্যাখ্যা ও পড়াশোনার সুযোগও। মহাকাব্যের যে এতরকম প্রেক্ষিত, এত রকম ব্যাখ্যা, সে সবকে বোঝার ও জানার সুযোগ মিলবে এখানে। কিছু দিন আগেই রামচরিত মানস আবৃত্তির একটি প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছিল সে রাজ্যের সংস্কৃতি দপ্তর। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ও বিজেতাদের জন্য ছিল বিশেষ অর্থ পুরষ্কারের ব্যবস্থাও।
আরও শুনুন: মসজিদের নিচে মিলল মন্দিরের মতো স্থাপত্যের নিদর্শন, চাঞ্চল্য মেঙ্গালুরুতে
সব মিলিয়ে সে রাজ্যের সরকার যে রাম-নামে বিজেপিকে জোর টক্কর দিতে পুরোপুরি তৈরি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ভূপেশ বাঘেলের ব্যাখ্যা, রাম আমাদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের মিশে রয়েছে। রামের মা কৌশল্যার বাপের বাড়ি অর্থাৎ কৌশল রাজ্যের অবস্থান এককালে ছিল এই ছত্তিশগড়ে়েই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাম তাঁদের একান্ত আপন। ছত্তিশগড়়বাসীর সঙ্গে রামের সম্পর্ক মামা-ভাগ্নের। আর হিন্দুত্ববাদের বাজারে সেই সম্পর্কেই জোর দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। রায়পুরের চান্দখুরিতে কৌশল্যার নামে একটি মন্দিরও রয়েছে। ‘রাম বন গমন’ প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হয়েছে সেই মন্দিরেরও। সম্ভবত সেটিই ভারতে একমাত্র মন্দির যা কৌশল্যার নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেন, “ছত্তিশগড়়ে রামের মাহাত্ম্যটাই অন্য। এ রাজ্যের সংস্কৃতির আনাচে কানাচে মিশে রয়েছে এই মহাকাব্য। আর বিজেপি যে ভাবে রামকে তুলে ধরছে, তার বাইরে গিয়েও তো হাজারটা ব্যাখ্যা রয়েছে রামায়ণের। সেটা গান্ধীর রাম হতে পারে, কবীরের রাম হতে পারে, তুলসীর রাম হতে পারে, বা হতেই পারে সেই শবরীর রাম। তাই সেই বিজেপির রামের বাইরে গিয়ে আমরা মহাত্মা গান্ধীর সেই রামের কথা মনে রাখতে চাই।”
আরও শুনুন: সাম্প্রদায়িক অশান্তির জেরে শ্রীলঙ্কার থেকেও বেহাল হতে পারে দেশের অর্থনীতি, আশঙ্কা সঞ্জয়ের
আসলে বিজেপির ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান বা সেই হিন্দুত্ববাদী ধারণার বাইরে গিয়ে অন্য রামায়ণকে তুলে ধরাই আপাতত লক্ষ ছত্তিশগড়় কংগ্রেসের। তাই গেরুয়ার বদলে গোটা অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল হলুদ রংকেই। যা আপাত ভাবে অনেক বেশি স্নিগ্ধ বলেই মনে করা হচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, আসলে রামভক্তির আড়ালে এভাবেই বিজেপি বিরোধিতার স্বরকে আরও তীব্র করে তুলতে চাইছে ভূপেশ বাঘেল সরকার। সমস্ত দলই বোধহয় রাজনৈতিক প্রয়োজনে কখনও না কখনও ধর্মকে অস্ত্র করেছে। আর হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে রুখতে সেই রাম-অ্যান্টিডোটকেই এবার ব্যবহার করতে চাইছে কংগ্রেস।