বাজারে মাছ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। কারণ, পাশেই রয়েছে মন্দির। সম্প্রতি এই দাবিতে দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকার এক বাজারে হাজির হয়েছিলেন একদল যুবক। রীতিমতো হুমকির সুরে সেখানকার মাছ ব্যবসায়ীদের তাঁরা ‘অনুরোধ’ করেছেন। ঘটনায় বিজেপির দিকে নিশানা করে সরব হয়েছেন তৃনমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র। তবে দিল্লির ঘটনা কি দেশের জন্য অশনিসংকেত?
শ্রাবণ মাসে আমিষ খাওয়া মুঘল সংস্কৃতির পরিচায়ক। এমনটা দাবি করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে বিষয়টা চাপা পড়ে যায়। মোটের উপর ধরে নেওয়া হয়, ভোটের আবহে রাজনৈতিক কারণেই এমন মন্তব্য করেছিলেন নমো।
তারপর বেশ কয়েকমাস কেটেছে। ভোটের হাওয়ায় অনেককিছু ওলটপালট করেছে। কেন্দ্রের মসনদে বিজেপি ফের নিজেদের জায়গা পাকা করেছে। এমনকি দিল্লির কুরশিও দখল করেছে গেরুয়া শিবির। এই আবহে নতুন করে ফিরেছে আমিষ-নিরামিষ দ্বন্দ্ব। ঘটনার কেন্দ্রে দেশের রাজধানী। আরও স্পষ্ট করে বললে, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক। বাঙালি অধ্যুষিত এই এলাকায় দুর্গা, কালী, অন্নপূর্ণা সব পুজোই ঘটা করে হয়। পা রাখলে বোঝার উপায় নেই, বাংলার বাইরের জায়গা। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানকার বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাসেও বাঙালি ছাপ স্পষ্ট। একেবারে মাছে-ভাতে-রসোগোল্লায় মেতে থাকেন রাজধানীর এই অংশে থাকা বাঙালিরা। এক নয়, একাধিক আমিষ দোকান রয়েছে। হরেকরকম মাছ, মাংস সবই মেলে। কিন্তু এমনটা আর করা যাবে না। মানে মনের সুখে মাছের বাজার দিল্লিতে থেকে আর করা যাবে না। চাইছেন, সেখানকার একদল হিন্দুত্ববাদী। তৃণমূল নেত্রী মহুয়ার ভাষায় বললে, গেরুয়া শিবির। সম্প্রতি চিত্তরঞ্জন পার্কের এক মাছের বাজারের ভিডিও পোস্ট করে এমনই বার্তা দিয়েছেন তিনি। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একদল যুবক প্রায় হুমকির সুরে বলছেন ওই চত্বরে আর মাছ বিক্রি করা যাবে না। অবশ্য এর জন্য বিশেষ যুক্তিও সাজিয়েছেন তাঁরা। বাজারের পাশেই থাকা এক মন্দিরকে উদ্দেশ্য করে তাঁরা বলেছেন, ওই মন্দিরের কারণেই আমিষ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। আর এতেই মহুয়ার তোপ, সবেমাত্র দিল্লির মসনদে বসেই বাঙালির সংস্কৃতি মুছে দিতে চাইছে বিজেপি!
একা মহুয়া নন, বিষয়টা নিয়ে সরব হয়েছেন আরও অনেকে। সোশাল মিডিয়ায় এই নিয়ে তর্ক যত জমেছে, তত সামনে এসেছে একের পর এক অভিযোগ। এবার অবশ্য কোনও দলের বিরুদ্ধে কোনও দলীয় সমর্থক বা নেতার নয়, একেবারে সাধারণ মানুষ। বলা ভালো, বাঙালির। যারা দীর্ঘদিন দিল্লির বাসিন্দা বলে নিজেদের দাবি করছেন, এবং অসহায়ের মতো জানাচ্ছেন, এলাকার আমিষ দোকান বন্ধ। মাছ না খেয়েই কাটাতে হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রমাণ হিসেবে সেসব সামনে এনে নিজের দাবি আরও জোরালো করেছেন মহুয়া। বিষয়টা প্রশাসন অবধি গড়িয়েছে। পুলিশ অবশ্য একেবারে অস্বীকার করেনি। সোশাল মিডিয়ায় ভিডিও প্রমাণ থাকার জন্যই হয়তো তেমনটা করতে পারেনি। দিল্লি প্রশাসন আশ্বস্ত করে জানিয়েছে, বিষয়টা খতিয়ে দেখবে তারা। তদন্ত হবে, কেউ অন্যায় করেছে প্রমাণিত হলে পদক্ষেপও করা হবে। তবে এখনও এই নিয়ে লিখিত কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি বলেও জানিয়েছেন পুলিশ আধিকারিকরা। একইভাবে ঘটনায় মুখ খুলেছেন দিল্লির বিজেপি সভাপতি। তিনিও বিষয়টা এড়িয়ে না গিয়ে, তদন্তের পক্ষে সওয়াল করেছেন। এরইমধ্যে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, ওই বাজার অনৈতিক বা অবৈধ নয়। সেখানে যারা মাছ বিক্রি করেন তারাও প্রশাসনের প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়েই ব্যবসা করেন। তাহলে সমস্যাটা স্রেফ ওই মন্দির নিয়েই!
এখানেই সামনে আসছে বাঙালির সংস্কৃতি। কালীক্ষেত্র কোলকাতায় এমন অনেক মন্দির রয়েছে যেখানে নিয়মিত আমিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। তারাপীঠ, কালীঘাটের মতো মন্দিরে পশুবলি হয়, সেই মাংসও দেবীর ভোগে যায়। একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে, এইসব প্রসিদ্ধ মন্দিরের অনতিদূরে বড়সর বাজার রয়েছে। সেখানে রমরমিয়ে মাছ-মাংস বিক্রি হয়। বাংলার শহর বা শহরতলিতেও এমন অনেক মাছের বাজার রয়েছে যেখানে প্রতিষ্টিত মন্দির রয়েছে। মাছ ব্যবসায়ীরাই সেই মন্দিরের দেখভাল করেন। বছরের এক-দুবার ঘটা করে পুজোও হয়। দিল্লির ওই বাজার বাঙালির এই সংস্কৃতিকেই বয়ে নিয়ে চলেছে। কিন্তু সেসব খোঁজ না নিয়েই হিন্দুত্ববাদী ওই যুবকের দল মন্দিরের দোহাই দিয়ে মাছের বাজার বন্ধ করতে ছুটেছিল। মন্দিরের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, এইভাবে মাছ বিক্রি কি বন্ধ করা যায়? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে ওয়াকিবহাল মহলে। তবে এ তো নতুন কিছু নয়।
খাবার নিয়ে মাঝে মাঝেই বিতর্ক উসকে ওঠে দেশে। দেশজুড়ে বিতর্কের মূল কেন্দ্রেই যেন এসে দাঁড়িয়েছে আমিষ আর নিরামিষের দ্বন্দ্ব। একাধিক ঘটনায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা আমিষ খান, খানিক বাঁকা চোখেই যেন দেখা হচ্ছে তাঁদের। এমনকি অনেক সময় সেই মনোভাব আর কেবলমাত্র কটাক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। খোদ বিবেকানন্দকে নিশানা করে এক ধর্মগুরুর আক্রমণ ছিল, যে সিদ্ধপুরুষ, সে কখনও মাছ খায়? বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে এই সুরে আক্রমণ ধেয়ে এসেছে বারে বারেই। যে আক্রমণের ভেতরে আদতে ‘এক দেশ এক খাদ্য’ এই গণ্ডি টেনে দেওয়ার চেষ্টাই চোখে পড়ে। পুজোর সময় রান্নার তেলের বিজ্ঞাপনে কেন মাছ ভাজার ছবি দেখানো হবে, তা নিয়েও ঝড় উঠেছে। শেষমেশ সেই বিজ্ঞাপনটি সরিয়েও নেয় সংস্থা। এক খাবার ডেলিভারি সংস্থা তো রীতিমতো আমিষ ও নিরামিষ খাবারের ডেলিভারির জন্য আলাদা পোশাকবিধি পর্যন্ত স্থির করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ প্রবণতা বলছে, ভাগাভাগির মাত্রা এতটাই যে, কর্পোরেট সংস্থা পর্যন্ত এই বিভাজনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই সবকিছু মিলেই যেন ক্রমশ দেশে এক বিভাজনের ন্যারেটিভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দিল্লির ঘটনাও এক ধাক্কায় সেই সমস্ত পুরনো কথাই যেন মনে করিয়ে দিল।
There was an unorganised market at CR Park. The DDA made a permanent market. The market association decided to construct a small kali and shiv temple on the market land so the owners and customers could pray there.
Now the goons want the fish market shut because the shops are… pic.twitter.com/Lgfnh8BSgR
— sanjoy ghose (@advsanjoy) April 9, 2025