‘সাহিত্যিকের কাজ, সবটুকু লিখে যাওয়া। চারপাশের যে অন্যায় চোখে পড়ে, তা যতদূর সম্ভব লিপিবদ্ধ করে রাখা। পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে ভুল-ঠিক বোঝানোয় বিশ্বাসী নই আমি। সে সিদ্ধান্ত বরং তাঁদের উপরেই ছাড়া থাক…’ – এমনটাই মনে করেন কন্নড় সাহিত্যিক বানু মুশতাক। তাঁর লেখা ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ সম্প্রতি জয় করেছে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৫। হিংসা-বিদ্বেষের পৃথিবীতে দাঁড়িয়েও বানু মুশতাক মনে করেন, যে কোনও স্বৈরাচারের পতন হবেই!
‘আমার নারী চরিত্রদের মাধ্যমে আমিই কথা বলি। কখনও চিৎকার করি, কখনও আর্তনাদ। আমাদের সমাজ যে যন্ত্রণা দেয় নারীদের, তা নিয়ে কথা বলি আমি। আমি মনে করি, সাহিত্যিক হিসেবে এ আমার কর্তব্য।’ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার চলাকালীন, দৃপ্ত কণ্ঠে এ কথা বললেন কন্নড় সাহিত্যিক বানু মুশতাক (Banu Mushtaq) । তাঁর লেখা ছোটগল্প সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ ‘হার্ট ল্যাম্প’ সম্প্রতি জয় করেছে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ২০২৫। বিশ্বমঞ্চে কন্নড় সাহিত্যের এমন স্বীকৃতির ঘটনা এই প্রথম।
একাধারে সাহিত্যিক, আইনজীবী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ বানু মুশতাকের (Banu Mushtaq)সাহিত্য জুড়ে স্থান পেয়েছে সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মুসলিম নারীরা। জন্মাবধি নারী-পুরুষের যে সামাজিক অবস্থানগত বিভাজন অভ্যেস করে সমাজ, সদ্যোজাত মানুষটিকেও তার অংশ করে তোলে, বানু মুশতাকের (Banu Mushtaq)সাহিত্যসৃষ্টির বিষয় হয়ে উঠেছে সেই সবই। কখনও আবার তা লিঙ্গ-পরিচয়ের উপরে উঠে, হয়ে গিয়েছে সার্বিক। নিম্নবিত্ত কৃষক, দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের যন্ত্রণার উপাখ্যানও ফিরে ফিরে এসেছে ওঁর লেখায়।
তবে সাহিত্য কি লেখকের ব্যক্তিজীবন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে পারে কখনও? ওঁর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বানু (Banu Mushtaq) নিজের জীবনে ছোট থেকে যা দেখে বড় হয়েছেন, তাই জায়গা করে নিয়েছে ওঁর সাহিত্যে। স্কুলে পড়তে তাঁর সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক, রীতিমতো ভাবিয়েছিল আত্মীয়দের। বাড়ি এসে বলে গিয়েছিল তারা, ‘এই মেয়ে পরিবারের নাক কেটে দেবে!’ মেয়েদের মুক্ত কণ্ঠস্বরই যে ‘রিগ্রেসিভ’ সমাজের সবচাইতে বড় শত্রু, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। বাবা অবশ্য বানুর পাশে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন অবলম্বন হয়ে। জানিয়েছিলেন, মেয়ের লেখাপড়ার ইচ্ছেয় পূর্ণ সমর্থন রয়েছে তাঁর। সেই সাহসকে ভরসা করে, সামাজিক গোঁড়ামিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেন বানু। নিজের জীবন দিয়েই যেন ভেঙে চলেন একের পর এক সামাজিক বাধা।
কর্মজীবনে সুযোগ পেয়েছেন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার। সেই সূত্রেই সমাজের পচা-গলা কাঠামোটাকে আরও ভিতর থেকে জানা। নানান প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জীবনযুদ্ধ একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন বানু, আর সে কথাই প্রায় ছয় দশক ধরে লিখে চলেছেন তাঁর গল্পে। ইংরেজি ছাড়াও বেশ কিছু স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর গল্পগুলি। পৌঁছে গিয়েছে সমাজের নানা স্তরের মানুষের কাছে। আর বানু মুশতাকের একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে লেখা সেসব গল্পে নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা মেয়েরা। বানু মুশতাকের (Banu Mushtaq) কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে শোষিত নারীর কলতান।
সাক্ষাৎকারে বানু মুশতাক (Banu Mushtaq) বলেন, ‘আমি মনে করি, সাহিত্যিকের কাজ, সবটুকু লিখে যাওয়া। চারপাশের যে অন্যায় চোখে পড়ে, তা যতদূর সম্ভব লিপিবদ্ধ করে রাখা। পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে ভুল-ঠিক বোঝানোয় বিশ্বাসী নই আমি। সে সিদ্ধান্ত বরং তাঁদের উপরেই ছাড়া থাক। আমি কেবল এই বিভাজন-প্রিয় পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা বেআবরু করে দিতে চাই জনসাধারণের সামনে।’ বর্তমানের হিংসা-বিদ্বেষের মাঝে দাঁড়িয়েই বানু মুশতাক (Banu Mushtaq) মনে করেন, কোনও কিছুই চিরন্তন নয়। যে কোনও স্বৈরাচারী শাসকের পতন হবেই, ইতিহাসই সে সাক্ষ্য দিয়েছে।
আসলে সংবাদের সত্য হয়তো বদলেও যেতে পারে, কিন্তু সাহিত্যের সত্য বদলায় না। কারণ কোনও বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মুখপত্র হওয়ার যেটুকু দায় সংবাদমাধ্যমের থাকে, সাহিত্যের চারিদিকে তেমন কোনও গণ্ডি টেনে দেওয়া সম্ভব হয় না। সেখানে রাজনৈতিক অথবা সামাজিক অবস্থার সমস্তটাই একেবারে অকপটভাবে ধরা পড়ে। আর সে জন্যই প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এক নারীর ‘বুকার’ জয়ের কৃতিত্ব লিঙ্গ-জাতি-বর্ণের ভেদাভেদ পেরিয়ে স্থান পায় বিশ্বের দরবারে। সামাজিক গোঁড়ামির অন্ধকারের বুকে জ্বলে থাকে জোনাকির মতো।