‘চ মানে চুমু খাওয়া ভালবেসে’… সুমনের এই গানের লাইন হয়তো এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে প্রেসিডেন্সির কোনও দেওয়ালে। পড়াশোনা, প্রেম আর পলিটিক্স, তিন ‘প’ নিয়েই নাকি প্রেসিডেন্সি, এককালে এখানে শোনা যেত এমন কথাই। সেই প্রেসিডেন্সিতেই নাকি বর্তমানে নিষেধের আঙুল উঠছে প্রেমের দিকে। পড়ুয়াদের দাবি, কেবল প্রেম নয়, এ আসলে তাঁদের নিজস্ব স্বরকেই চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ঘটনায় শঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীরাও। কে কী বলছেন এই নয়া নিয়ম নিয়ে? জানালেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী এবং যশোধরা রায়চৌধুরী। শুনলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ নিয়ে এক মজার গল্প শুনিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটিতেই পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তাঁদের সময়ে সেখানে দেখা মিলত হাতেগোনা ছাত্রীর। মেয়েদের বাইরের জগতে আনাগোনার ক্ষেত্রে তখনও গণ্ডি টানা ছিল অনেকখানিই। তাই কোনও অচেনা ছেলের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদেরও যেমন বাধা ছিল, তেমনই ছেলেদের দিক থেকেও অস্বস্তি কম ছিল না। এই যখন অবস্থা, সে সময়ে একদিন ক্লাস নিতে এসেছেন জনৈক সাহিত্যের অধ্যাপক। ক্লাসের একদিকে ছেলেরা আর একদিকে মেয়েরা বসে আছে, এহেন দৃশ্য তাঁর একেবারেই মনঃপূত হয়নি। তাই সকলকে উঠিয়ে ছাত্রছাত্রীদের একসঙ্গে মিলিয়েমিশিয়ে বসার ব্যবস্থা করেন সেই অধ্যাপক। কিন্তু সে-দৃশ্য দেখে আবার বেজায় চটে গিয়েছিলেন পরের ক্লাসের অধ্যাপক। সবাইকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনেই তাঁর শান্তি হয়নি, ছাত্র আর ছাত্রীদের দুই সারির মাঝখানে একটা আস্ত বেঞ্চ দিয়ে দেওয়াল তুলে তবে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কর্তৃপক্ষের আচরণে সেই অধ্যাপকেরই যেন ছায়া দেখা যাচ্ছে, এমনটাই দাবি সেখানকার বর্তমান পড়ুয়াদের। যদিও মাঝখানে কেটে গিয়েছে প্রায় সত্তর বছর সময়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে ছাত্র আর ছাত্রীদের অবাধ মেলামেশায় কোনও বাধা আসতে পারে, এমনটা শুনে তাই হতবাক প্রাক্তনীরাও। বিশেষ করে যে প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই মুক্তচিন্তার আখড়া বলে খ্যাত, সেখানে এহেন বিধিনিষেধ চাপালে প্রেসিডেন্সির ‘আত্মা’টিকেই পালটে দেওয়া হয় বলে মনে করছেন তাঁরা।
হ্যাঁ, সম্প্রতি ‘নীতিপুলিশি’-র অভিযোগে তোলপাড় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। পড়ুয়াদের অভিযোগ, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে কি না, তা নিয়েই কার্যত প্রশ্ন তুলছেন কর্তৃপক্ষ। একাধিক যুগলের অভিভাবকদের তলব করা হয়েছে। সন্তানদের আচরণের সিসিটিভি ফুটেজ তাঁদের দেখানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে পড়ুয়াদের। এমনকি পড়ুয়া ও অভিভাবকের যৌথ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, ব্যক্তিগত মুহূর্তকে প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে। কিন্তু সেই মুহূর্ত কতখানি ব্যক্তিগত, আর সেই সীমাই বা কে ঠিক করে দেবে, প্রশ্ন প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের। তাঁদের সাফ কথা, পড়ুয়ারা এমন কোনও আচরণ করেননি, যা প্রেসিডেন্সি আগে দেখেনি। সত্যি বলতে, প্রেসিডেন্সির একটা গোটা রাস্তারই নাম ছিল লাভার্স লেন। আর কেবল প্রেমিক প্রেমিকা কেন, পোস্টার লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে এক বন্ধুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে আর-এক বন্ধু, কোয়াডে এমন ছবি দেখা যেত হামেশাই। সেই প্রেসিডেন্সিতেই এমন ‘ফতোয়া’ জারি হয়েছে শুনে রীতিমতো আশ্চর্য প্রাক্তনীরা। আইএএস এবং নামী সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী যেমন স্পষ্টই বললেন, কর্তৃপক্ষের যদি পড়ুয়াদের প্রতি বিশ্বাস না থাকে, তাহলে চলবে কেমন করে? তাঁর সময়ে প্রেসিডেন্সি ঠিক কেমন ছিল, এর উত্তরে তিনি জানালেন- তাঁদের পরীক্ষার হলে পর্যন্ত নজরদারি করেননি অধ্যাপকেরা। তাঁরা জানিয়েছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়ারা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নিতে পারবে।
পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করলেন আর-এক প্রাক্তনী যশোধরা রায়চৌধুরীও। তিনিও পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারি আমলা, পাশাপাশি খ্যাতনামা সাহিত্যিক। তাঁর মতে, ছাত্র-যুবদের স্বাধীন চেতনাকে দমিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। আর সেই চেষ্টা শুরু হয় শরীরের স্বাধীনতাকে খর্ব করার মধ্যে দিয়েই। একে হিমশৈলের চূড়া বলেই মনে করছেন যশোধরা। তিনি বললেন- এই বিষয়টি এখানেই থেমে থাকবে না। আসলে স্বাধীনতাকে, স্বায়ত্তকে আক্রমণ করাই এর লক্ষ্য বলে ভয় হচ্ছে।
সত্যি বলতে, শুধু প্রেমের অধিকারই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদতে তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকারকেই খর্ব করতে চাইছেন বলে দাবি পড়ুয়াদের। ডিন অফ স্টুডেন্টস অরুণ মাইতিকে এ বিষয়ে ডেপুটেশন দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে একটি আচরণবিধির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেই কোড অফ কনডাক্টে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে মিটিং–মিছিল করা যাবে না। কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে প্রেসিডেন্সি সংক্রান্ত কোনও অডিয়ো-ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে দেওয়া যাবে না। এমনকি নিরাপত্তারক্ষীরা ক্যাম্পাসের যে কোনও জায়গায় পড়ুয়াদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারেন, একইসঙ্গে রেজিস্টারে স্বাক্ষর না করে প্রাক্তনীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন না বলেও নির্দেশ কর্তৃপক্ষের। এমনিতেই বর্তমান ভিসি অনুরাধা লোহিয়ার আমল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বজ্র আঁটুনি চাপানো হয়েছে বলে দাবি প্রাক্তন ও বর্তমান পড়ুয়াদের। নিজের কলেজে ঢুকতে গেলে যেভাবে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তার দরুন অভিমানে কলেজে যাওয়া ছেড়েছেন অনেক প্রাক্তনীই। পড়ুয়াদের অভিযোগ, আসলে বাকি দুনিয়া থেকে প্রেসিডেন্সিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং তার অন্দরের খবর বাইরে আসতে না দিয়ে স্বৈরাচার কায়েম করতে চাইছেন কর্তৃপক্ষ। যাতে সরকার বা সরকারপোষিত এই প্রতিষ্ঠানের কোনও ত্রুটির দিকে কারও আঙুল না ওঠে। আর সেই একই আশঙ্কার কথা শোনা গেল প্রাক্তনীদের গলাতেও।