ইউক্রেন থেকেই পেয়েছেন সন্তানসুখ। সেখানেই নিজের সন্তানের সারোগেট মাকে খুঁজে পেয়েছেন বহু দম্পতি। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সারোগেসি কেন্দ্রগুলির একটি এই ইউক্রেন। ইতিমধ্যেই রুশ হামলার কবলে সেখানকার বহু ফার্টিলিটি ক্লিনিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে কেমন আছেন সেসব সারোগেট মায়েরা? শুনে নিন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে আজ যে দিকেই তাকানো যায়, সেখানেই ধ্বংস আর মৃত্যুর চিহ্ন। একের পর এক শহরে হামলার পর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ সেনা। ক্রমশ তীব্র হচ্ছে পারমাণবিক হামলার সম্ভাবনা। ইতিমধ্যেই প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অসংখ্য ইউক্রেনবাসী। অথচ দিন কয়েক আগেও আর পাঁচটা দেশের মতোই সুস্থ, স্বাভাবিক ছিল দেশটা। প্রতিবছরই হাজার হাজার দম্পতি ইউক্রেনে আসতেন সন্তানলাভের আশায়। আমেরিকার পরে অন্যতম বড় সারোগেসি কেন্দ্রগুলির একটি ইউক্রেন। বহু বিদেশি দম্পতিই সন্তান লাভের আশায় ভিড় করেন এ দেশে। প্রতিবছর ইউক্রেনে দুই থেকে আড়াই হাজার শিশু জন্মায় সারোগেসির মাধ্যমে। আমেরিকা, ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে বহু দম্পতি এখানে আসেন গর্ভ ভাড়া করতে। বেশ কিছু ফার্টিলিটি সেন্টারও রয়েছে ইউক্রেনে।
হঠাৎ করে যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েছেন সন্তানের আশায় ইউক্রেনে ভিড় করা দম্পতিরা। তাঁদের অনেকেরই ডিম্বাণু হয়তো সঞ্চয় করা রয়েছে ইউক্রেনের সেসব ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলিতে। ইতিমধ্যেই রুশ হামলার কবলে পড়েছে বেশ কয়েকটা ক্লিনিক। ফলে বিপাকে তাঁরাও। পাশাপাশি সারোগেসির মাধ্যমে অন্যের জন্য গর্ভধারণ করা অনেক মহিলাই বিপদে পড়েছেন এই পরিস্থিতিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে কেউ কেউ পালাতে পেরেছেন, কেউ পারেননি।
আরও শুনুন: বন্ধুত্বের আবার ‘দেশ’ হয় নাকি! ইউক্রেনের শরণার্থী শিশুকে জড়িয়ে ধরে স্কুলে স্বাগত জানাল খুদেরা
ক্যালিফর্নিয়ার এক দম্পতির কথাই ধরুন। সারোগেসির মাধ্যমেই দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাঁরা। তাদের সারোগেট মা ইউক্রেনের বাসিন্দা। সদ্যজাত সন্তানটিকে নিয়ে কোনও মতে ইউক্রেন ছাড়তে পেরেছেন ক্যালিফর্নিয়ার পরিবারটি। পৌঁছেছেন কোস্টা মেসায় নিজেদের বাড়িতে। সন্তানকে নিয়ে ফিরে তো এসেছেন, কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে একটি ব্যাপার। নিজেরা তো পালিয়ে বেঁচে গেলেন। কিন্তু তাঁদের দুই সন্তানের গর্ভধারিনী মাকে বের করে আনতে পারেননি যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে। তিনি আজ কী অবস্থায় রয়েছেন, তা ভেবে রোজই উৎকন্ঠায় দিন কাটছে ক্যালিফর্নিয়ার ওই দম্পতির।
আসলে অনেকেই যুদ্ধ থামার আশায় বুক পেতে রয়েছেন এখনও। প্রাণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভিটেমাটি, ঘরদোর ছেড়ে বেরোতে চাননি তাঁরা। মাথার উপর বোমারু বিমানের চক্কর, গুলির শব্দ, যুদ্ধের সাইরেন নিয়েও তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কোনওমতে।
আরও শুনুন: যুদ্ধের আঁচে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল একাই, অবশেষে মায়ের দেখা পেল ইউক্রেনের খুদে
ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ারের দম্পতির গল্পটাও খুব আলাদা নয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধঘোষণার মাত্র ২ সপ্তাহ আগেই কিয়েভ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরেছেন হিথার ও মার্ক ইস্টন নামে ওই দম্পতি। সঙ্গে সদ্যোজাত সোফি। তার পরেই ইউক্রেনে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। ক্যালিফর্নিয়ার দম্পতির মতোই তাঁদের সারোগেট মা ভিটা লিসেঙ্কোর জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলেন হিথাররা। তবে লিসেঙ্কোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি তাঁরা খবর পান ইউক্রেন থেকে পালাতে পেরেছেন লিসেঙ্কো ও তাঁর পরিবার। তবে তাঁদের কারওর কাছেই ভিসা বা পাসপোর্ট নেই।
এতদিন কোনওমতে বাঙ্কারে মাথা লুকিয়ে ছিলেন লিসেঙ্কো, তাঁর সঙ্গী ও তাঁদের বছর তিনেকের ছেলেটি। প্রাথমিক ভাবে দেশ ছেড়ে আসতে রাজি ছিলেন না তাঁরা। তবে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ জায়গায় পৌঁছয় যে পালানো ছাড়া উপায় ছিল না। প্রায় ৬ দিন ধরে গাড়ি চালিয়ে তাঁরা পৌঁছন ব্রাসেলসে। তবে ব্রিটেনে ঢোকার অনুমতি পেতে লেগে যায় আরও ৬ দিন। আপাতত হোমস ফর ইউক্রন প্রকল্পের আওতায় ব্রিটেনে ঢুকতে পেরেছে পরিবারটি। ইস্টন প্রাণপন চেষ্টা করছেন, যাতে কোনও ভাবে লিসেঙ্কোদের ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। ইতিমধ্যে সেখানকার প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগও করেছেন তিনি।
খুব শিগগিরই লিসোঙ্কো ভিসা পেয়ে যাবেন বলেই আশাবাদী হিথার ও ইস্টন। ইতিমধ্যে তাঁদের জন্য বাড়ির পাশেই একজন স্পনসরও জোগার করে ফেলেছেন তাঁরা। যাতে যুদ্ধ সব হারিয়ে ফের নতুন করে শুরু করতে পারেন লিসেঙ্কোরা। আপাতত তাদের দুই শিশুর সারোগেট মায়ের পরিবারকে নিজেদের থেকে বেশি দূরে পাঠাতে চাননা হিথার। তাঁদের সন্তানসুখ এনে দিয়েছেন যিনি, তাঁর ঋণ বোধহয় এত সহজে শোধ হবে না।