‘স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কী করবেন?’ বনাম ‘স্ত্রীর দিকে তাকালে ক্ষতি কী?’ ! কর্মসংস্কৃতির তর্ক এখন ঘুরে গিয়েছে পুরুষের পেশা বনাম ব্যক্তিগত সম্পর্কে। মুখোমুখি বসিবার রবিবার আদতে থাকবে কি থাকবে না, ভবিষ্যৎ জানে। তবে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়ার চর্চাটুকু অন্তত ফিরল এই সুবাদেই।
রবিবার বাড়ি বসে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী হবে! তার থেকে কাজে চলে আসুন। সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা কাজের নিদান দিতে গিয়ে এল অ্যান্ট টি-র চেয়ারম্যান যথারীতি টেনে এনেছেন পিতৃতন্ত্রের চেনা চচ্চড়ি। ভারতীয় কর্মসংস্কৃতির বদল নিয়ে এই মুহূর্তে সোচ্চার শীর্ষকর্তারা। ৭০ ঘণ্টা নিয়েই ছিল যথেষ্ট হইচই। একা রামে রক্ষে নেই,দোসর হয়েছে ৯০ ঘণ্টার ফরমান। তা এমন মত কেউ প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু সেই সূত্রে তিনি যে প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তা প্রাচীন এক কুসংস্কার। যেন ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী’র সঙ্গে সময় কাটানো নেহাতই মূল্যহীন। এর পালটা বক্তব্যগুলোও বেশ চোখে পড়ার মতো। শিল্পপতি আনন্দ মাহিন্দ্রা বলছেন, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে তিনি ভালোই বাসেন। আর এক শিল্পপতি আদার পুনাওয়ালা বলছেন, শুধু তিনি কেন, তাঁর স্ত্রী-ও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করবেন। মোদ্দা কথা, ৯০ ঘণ্টার দৌলতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের গুরুত্ব যেন এবার চর্চায় ফিরে এসেছে।
জ্বলা গুট্টা, দীপিকা পাড়ুকোন থেকে শুরু করে বহু মহিলাই এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। মন্তব্যের মধ্যে যে নারীবিদ্বেষী ইঙ্গিত আছে, তা নিয়েই যাবতীয় সমালোচনা। কিন্তু চাকরি আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কি পরস্পরবিরোধী! কেনই বা পুরুষের চাকরির ক্ষেত্রে নারীকে এরকম এক বিপ্রতীপ অবস্থানে রাখা হয়! সম্ভবত এর মূল সূত্র রাখা আছে উনিশ শতকেই। ইংরেজ জমানায় তখন সবে তৈরি হতে শুরু করেছে ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এঁদের মূল পেশা চাকুরি। সমাজজীবনে বড় বদল ঘটছে। চাকুরির বাঁধা গণ্ডিতে তখন একটা শ্রেণি নিজেদের অভ্যস্ত করে নিচ্ছে, হাঁফিয়েও উঠছে। ইংরেজরা চাকুরিজীবী শ্রেণি তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে বটে, কিন্তু চাকুরির উচ্চপদ নিজেদের জন্যই বরাদ্দ রেখেছিল। ফলত একদিকে ঊর্ধ্বতনের ধ্যাতানি, অন্যদিকে সংসার সামলানোর দায়। মূলত এই শ্রেণি ছিল এমনই সাঁড়াশি চাপে ক্লিষ্ট। ঠিক এরকম একটা আবহই যেন পুরুষের পেশা আর সহধর্মিণীকে একেবারে বিপরীত অবস্থানে রেখেছিল। এমন একটা ধারণা গড়ে উঠছিল যে, পুরুষের যাবতীয় সমস্যার কারণ নারীই। নারীর বস্তুগত নানাবিধ চাহিদাই বাধ্য করছে পুরুষকে চাকরি করতে। বলা বাহুল্য, এ আরোপিত ধারণা। কিন্তু এটুকু বলা যায় যে, পুরুষের চাকরির ক্ষেত্রে আজও যে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য উচ্চারিত হচ্ছে, তার বীজ তোলা আছে অনেক গভীরেই। এল অ্যান্ড টি-র চেয়ারম্যানের বক্তব্য তাই বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখলে চলে না।
তবে, দুর্ভাগ্য যে, এত বছর পরেও সেই বিদ্বেষের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তাই কাজের সময় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সওয়াল করতে গিয়ে সেই প্রাচীন ধারণাই ফিরে ফিরে আসছে। কাজ-জীবনের ভারসাম্যের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনকে গুরুত্ব দেওয়াও খারাপ কিছু নয়, বরং তা জরুরি। দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে পরস্পরকে সময় দেওয়ার কথাই বলে থাকেন সম্পর্ক-বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ দাম্পত্যের চাবিকাঠিই হল একে অন্যের সঙ্গে সময় কাটানো। হতে পারে, একসঙ্গে সাংসারিক কাজ করা। বা, পরস্পরের অনুভবের জায়গাগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া। শারীরিক সম্পর্ক বা যৌনতা যেমন জরুরি, পাশাপাশি মনের জানলাগুলো খোলা রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। কর্পোরেট তার নিজস্ব চরিত্রেই তা বন্ধ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তবে, সদর্থক কথা এই যে, নারীবিদ্বেষী মন্তব্য যেমন আছে, তেমন তার প্রতিবাদও হয়েছে। এই প্রজন্মের তারকারা – সে বিরাট কোহলি হোন বা রণবীর সিং – প্রকাশ্যেই স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছেন যে এতে অন্যায় কিছু নেই।
ধীরে হলেও সময় বদলায়। বদলাচ্ছেও। ছুটি জরুরি, আর ছুটির দিনে স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোও দোষের কিছু নয়। বরং জরুরি। নব্বই ঘণ্টা কাজের অবাস্তব চর্চায় যে এই বাস্তব কথাটি গুরুত্ব পেল, তাই-ই বা মন্দ কী!