সুখ আর অসুখ-এর মধ্যে দূরত্ব মাত্র একখানা ‘অ’-এর। তবে, অসুখ যেরকম সুলভ, সুখ তেমনই দুর্লভ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সুখ যারে কয় সকল জনে, তার সন্ধানে নেমে বলেছেন, পাইনে পাইনে…। তবু সুখের খোঁজ কি ছাড়া যায়?
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও।- পরামর্শ দিয়েছিলেন কবি। কিন্তু কথা হচ্ছে, কী যে সেই সুখ, তার সংজ্ঞা ঠিক করবে কে? আর সুখ কী তা না জানলে তার সন্ধানই বা করা যায় কেমন করে! পরশপাথরের মতোই, তাকে খুঁজে খুঁজেই যে কতজনের বেলা গেল! কিন্তু মরীচিকার মতোই সে নাকি কখনও দেখা দেয় তো কখনও পলকে যায় মিলিয়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, সুখ যারে কয় সকল জনে, তার সন্ধানে নেমে বলেছেন, পাইনে পাইনে…।
আরও শুনুন:
World Story Telling Day: তুমি তোমার গল্প বলো, আমি আমার গল্প বলছি…
তাহলে সুখ কি সত্যিই সেই ডুমুরের ফুলের মতো অসম্ভব কোনও বস্তু, সত্যিই যার নাগাল মেলে না? কিন্তু সে কথাই বা বলা যায় কেমন করে! বরং এ কথা হয়তো বলা যায়, সে আসলে সাধনারই ধন। যা কিছু দুর্লভ, তারই তো দাম বাড়ে। যে পাওয়া বড়, সহজে পেলে বুঝি তাকে ঠিক তেমন করে মূল্য দেওয়া যায় না। সুখ তো তেমনই বড় পাওয়া, তাই তেমন করে সাধনা না করলে তা মেলে না।
যা সহজে মেলে না, তা পাওয়ার পথও দুর্গম। সুখের সাধনা যদি বা করা যায়, সেই গন্তব্যে পৌঁছনোর পথেও কাঁটা তোলে বিস্তর ভ্রান্তি আর ভুল। রবীন্দ্রনাথই যেমন বলেন, এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম/ প্রেম মেলে না/ শুধু সুখ চলে যায়। একে অন্য বলে ভুল করলেই পথ হারাতে হয় আসলে। আর সেই ভ্রান্তি বিষম হয়ে দেখা দেয়, যখন আরাম আর সুখ একই ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হয়। অতএব অবধারিত সীতাহরণ। আরামের পুষ্পকে মানুষ উড়ে যায়। কিন্তু বস্তু কি আর সুখ আনতে পারে? যারা পাবার জিনিস হাটে কেনে, আর তা ঘরে ভরে রাখে, সেই গচ্ছিত ধনকে কি আর সুখ বলা যায়!
‘সুখী কে?’ মহাভারতে বকের এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠিরের উত্তর ছিল, যার ঋণ নেই, আর দিনের শেষে যার ঘরে শাক ভাতের জোগান রয়েছে, সে-ই সুখী। যুধিষ্ঠিরের এই কথায় হয়তো ভিন্নমত থাকতেই পারে। বিশেষ করে সেই প্রাচীন কাল থেকেই তো প্রবাদে রয়েছে ঋণ করে ঘি খাওয়ার কথা। অর্থাৎ সাময়িক সুখের জন্যই ঋণ পর্যন্ত নিতে পিছপা হচ্ছে না কেউ কেউ। অর্থাৎ সেই সুখ আর আরামের গুলিয়ে যাওয়ার সুযোগ। আদতে সুখ আর অসুখ-এর মধ্যে দূরত্ব মাত্র একখানা ‘অ’-এর। স্বল্পে তুষ্ট হলে আর অসুখের বালাই নেই। রাজার তাই অসুখ হয়, কিন্তু অসুখ নেই ফকিরের- “আমরা তো অল্পে খুশি, কী হবে দুঃখ করে?/ আমাদের দিন চলে যায় সাধারণ ভাতকাপড়ে।” আবার দুঃখ মানেই কিন্তু অসুখ নয়, সুখের বিপরীতও নয়। কেননা এমন দুঃখও তো আছে যা ভোলার মতো দুঃখ আর নেই। অর্থাৎ সেই দুঃখকে প্রাপক এখানে গ্রহণ করছেন সুখেরই নামান্তরে।
আরও শুনুন:
ভাতঘুম কিংবা ঘুম-ঘুম ক্লাসরুম! ঘুম সকলেরই ‘বার্থ রাইট’
দুঃখও কখনও কখনও, কারও কারও কাছে সুখ হয়ে ওঠে। ‘যারে যায় না পাওয়া তারই হাওয়া’-তে তো দুঃখ লেগে থাকারই কথা ছিল, কিন্তু তাও তো আসলে একরকম সুখের কথা বলে। এমন করেই যেন বুঝে নেওয়া যায়, আসলে সুখের গন্তব্যে পৌঁছনোর পথে যে না-পাওয়ার দুঃখের আনাগোনা, তা না থাকলে সুখের পূর্ণ আস্বাদ মেলে না। সুখ তো আসলে বাইরের কোনও পরশপাথর নয়, আসলে মানুষের মনেই তার ঘরবসত। ছাইগাদায় থাকা সেই গুণমণি গাছের মতো, মানুষের মনের সে গুণ আসলে দুঃখ না পেলে ফুটে ওঠে না। তাই সুখের জন্য একটা দিন আদতে যথেষ্ট নয়। সুখ একধরনের জীবনচর্যা। তবু একটা দিন যদি সুখের কথা ভাবা যায়, তবে সুখের হয়তো আর একটু কাছাকাছিই পৌঁছনো যায়। তাই বা মন্দ কী!