কুতুব মিনার নিয়ে সম্প্রতি আবার বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছে। দাবি উঠেছে, যে সমস্ত হিন্দু ও জৈন মন্দির ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছিল এই বিজয়স্তম্ভ, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। কেউ দাবি তুলেছেন, এই স্তম্ভের নাম বদলে রাখতে হবে বিষ্ণুস্তম্ভ। ইতিমধ্যেই মিনার সংলগ্ন চত্বরে খননকার্যের অনুমতি মিলেছে। এই সংক্রান্ত একটি মামলা শুনতেও রাজি হয়েছে দিল্লির আদালত। এই যে দাবি উঠছে, তার নেপথ্য কারণ কী? ইতিহাসের আলোয় এর কি কোনও সত্যতা মেলে? কোন তথ্যের ভিত্তিতে এই দাবি, আসুন শুনে নেওয়া যাক।
কুতুবউদ্দিন আইবকের বিজয়স্তম্ভ হিসাবেই খ্যাত কুতুব মিনার। মরচেহীন এই লৌহস্তম্ভ একদিকে কৌতূহল জাগিয়েছে বিজ্ঞানীদের, অন্যদিকে এই স্তম্ভ নিয়ে কৌতূহল ইতিহাসবিদদেরও। স্তম্ভের বয়সকাল মেপে যা দেখা যায়, তাতে অনেকেরই ধারণা হয় যে, কুতুবউদ্দিনের আগেও এই স্তম্ভের অস্তিত্ব ছিল। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছে ইতিহাসের খোঁজ। বর্তমানে কেন নতুন করে এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিল এবং এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি-না, সে আলাদা কথা। তবে স্তম্ভের উৎস সন্ধানে বহুকাল যাবৎ চলেছে গবেষণা।
আরও শুনুন: হিন্দু রাজার জমিতেই গড়ে উঠেছিল তাজমহল, কীসের বিনিময়ে পেয়েছিলেন শাহজাহান?
স্তম্ভের উৎসের খোঁজে সবথেকে সহায়ক হয়েছে স্তম্ভের গায়ে খোদিত সংস্কৃত-ব্রাহ্মী লিপিতে খোদাই করা বার্তা। প্রখ্যাত আর্কিওমেটালার্জিস্ট ড. আর বালাসুব্রমনিয়ান এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। এই লিপি থেকে বহু সূত্রেরই সন্ধান মিলেছে ক্রমশ। যেমন এই লিপি থেকেই ইঙ্গিত মেলে গুপ্ত যুগের। খোদিত লিপি থেকে পাওয়া অন্যতম আরও দুটি তথ্য হল, রাজা চন্দ্রের নাম এবং বিষ্ণুপদগিরি নামক জায়গার উল্লেখ। কেননা, লিপি অনুযায়ী স্তম্ভটি আসলে ছিল ওই বিষ্ণুপদগিরিতেই। এবং তা নির্মাণের নেপথ্যে আছে রাজা চন্দ্রের অবদান। এই দুটি বিষয় নিয়েই ইতিহাসবিদদের মধ্যে বহু মতপার্থক্য আছে। কে রাজা চন্দ্র? কোথায় বিষ্ণুপদগিরি? এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কেন যে স্তম্ভের গায়ে মরচে পড়ে না, তা নিয়ে খোঁজ চালাতে গিয়েও এই অতীতের অভিমুখী হয়েছেন বিজ্ঞানীরাও। কেননা আসল উৎস জানা গেলেই এই বিজ্ঞান বা কারিগরীরি গুরুত্বপূর্ণ দিকটির উদ্ঘাটন সম্ভব।
আরও শুনুন: শাহজাহান একা নন, ‘তাজমহল’ বানিয়েছিলেন আরও অনেকেই! কোথায় কোথায় রয়েছে সেগুলি?
বিভিন্ন গবেষণার সূত্রেই ক্রমে যে মতটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল বিষ্ণুপদগিরি বলে যে প্রাচীন জায়গার কথা স্তম্ভে খোদাই করা আছে, তা আসলে হল বর্তমান উদয়গিরি। বিষ্ণু ও চন্দ্র দুয়েরই অনুষঙ্গ মিলেছে এই জায়গায়। এক এক করে সেই সূত্রগুলি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। অতীত ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান বা সূর্যবিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে কর্কটক্রান্তি রেখার উপর অবস্থিত জায়গাগুলি অত্যন্ত সম্পৃক্ত। তার বহু নিদর্শন মিলেছে দেশের বহু প্রান্তে। ঠিক একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ উদয়গিরিও। গুপ্ত যুগের আগে থেকেই সেখানে এই চর্চা ছিল বলে মত ইতিহাসবিদদের, গুপ্ত যুগে এসে এই চর্চা আরও বাড়ে। আবার এই গুপ্ত যুগেই বিষ্ণুর ভজনা ছিল অন্যতম বিষয়। অতীত ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা বিশেষত সূর্যের গতিপথ পর্যবেক্ষণের মতো বিষয় এবং বিষ্ণু ভজনার ঐতিহ্য কালক্রমে মিলেমিশে গিয়েছে এই লৌহস্তম্ভের ইতিহাসে।
আরও শুনুন: মমতাজের সমাধি ছিলই না আগ্রায়, তবে কেন তাজমহল গড়েছিলেন শাহজাহান?
লিপি থেকে পাওয়া ‘বিষ্ণুপদ’ শব্দটিকেও পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। উদয়গিরিতে দেবতার চরণ বা পদ-কে পুজো করার ঐতিহ্য ছিল। জৈন তীর্থঙ্করের ক্ষেত্রেও এই রীতিতে পদ অর্চনার প্রমাণ মিলেছে। গুহার আকৃতির সঙ্গেও এর সাদৃশ্য মিলেছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলের একটি ‘সিল’ বা মুদ্রা থেকে পাওয়া গিয়েছে ‘বিষ্ণুপদস্বামী’ শব্দটিও। একই সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের খোঁজে মিলেছে আরও যোগসূত্র। যেমন ওই অঞ্চলে যে লোহা তৈরির কাজ হত, তাও স্পষ্ট হয়েছে। নিকটবর্তী অঞ্চলে বিভিন্ন স্তম্ভ এবং স্থানীয় জায়গার নামে ‘লোহা’ শব্দটির উল্লেখও অন্যতম যোগসূত্র হিসাবে বিবেচনা করেছেন গবেষকরা। কেউ কেউ মনে করেন এই স্তম্ভটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর উপর ছায়াপাত ঘটে। সূর্য পর্যবেক্ষণে বিশেষ ব্যুৎপত্তি না-থাকলে এই কাজটি সম্ভব হত না। অর্থাৎ ওই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সূত্রটিও এখানে খেটে যায়। এ ছাড়া পাশ্ববর্তী অন্যান্য গুহায়, বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উপস্থিতি বা অবদানও পরীক্ষা করে দেখেছেন ইতিহাসবিদরা। নানা লিপিতে তার উল্লেখ মিলেছে।
আরও শুনুন: তাজমহলের জায়গায় একদা ছিল মন্দির, ঠিক কার হাত ধরে সূত্রপাত এই বিতর্কের?
এই সমস্ত যোগসূত্র মিলিয়েই একটি ধারণা জোরালো রূপেই প্রতিষ্ঠিত যে, লৌহস্তম্ভটি আসলে ছিল উদয়গিরিতেই। এবং সেটির বয়স প্রায় ১৬০০ বছর। কেননা গুপ্ত যুগের সময়কাল ৩২০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ। অন্যদিকে কুতুবউদ্দিনের স্তম্ভ স্থাপনের সময়কাল ১১৯২ থেকে ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এই সময়ই স্থাপিত হয়েছিল ‘কুয়াত-উল-ইসলাম’ মসজিদটি, যার সংলগ্ন চত্বরেই মিনারের অবস্থান। ইসলামিক স্থাপত্য হলেও মসজিদটির নির্মাণের কারিগররা হিন্দু ছিলেন বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। ওই অঞ্চলের অনেকগুলো মন্দির থেকে মসজিদ তৈরির রসদ জোগাড় করা হয়েছিল বলেও মনে করা হয়। কেন লৌহস্তম্ভে মরচে পড়ে না সে নিয়েও বহু গবেষণা হয়েছে। মনে করা হয়, ফসফরাসের পরিমাণ বিশেষ মাত্রায় রাখার দরুনই স্তম্ভটি এমন অক্ষত অবস্থায় দীর্ঘদিন রয়ে গেছে। সে অবশ্য আলাদা আলোচনার বিষয়। তবে কুতুব মিনারের প্রাচীন অবস্থান নিয়ে যে বিতর্ক বহুকাল ধরে চলছে, তা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে ওই উদয়গিরিতেই। অর্থাৎ দিল্লিতেই যে আগাগোড়া স্তম্ভটি ছিল না, এমন মতই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জোরের সঙ্গে। বিভিন্ন তথ্য ও তাদের ভিতরকার যোগসূত্র উদয়গিরি ও বিষ্ণুর সঙ্গে এই স্তম্ভের সম্পর্কের দিকেই আলো ফেলেছে।
আপাতত পুরো বিষয়টিই আদালতের বিবেচনা সাপেক্ষ। এএসআই-এর বর্তমান খননকার্য হয়তো এই ইতিহাসের সত্যতা সম্পর্কে আরও আলোকপাত করতে পারবে। তাতে মিনার সম্পর্কিত সমস্ত সন্দেহ এবং যুক্তি তর্কের অবসান হবে বলেই আশা করা যায়।